গৌতম ঘোষের সরল ছেলেমানুষি ও সীমান্তের শঙ্খচিল/মিতুল আহমেদ

প্রায় তিন বছর পর সিনেমায় হাত দিলেন গৌতম ঘোষ। তাও দুই দেশের যৌথ নির্মাণ!এর আগেও যৌথ উদ্যোগে সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। তবে এবারেরটা ভিন্ন। আগে যে দুটি যৌথ সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা তার আছে তা মূলত ছিলো দুটি তৈরি করা গল্পের অ্যাডাপটেশন! একটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, আর অন্যটা সুনীল গাঙ্গুলীর মনের মানুষ। দুটো ছবি ভারতে কেমন সাড়া ফেলেছিল তা অজানা থাকলেও বাংলাদেশে ছবি দুটো উচ্চ ও বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। ফলে গৌতম ঘোষের ছবি মানেই উচ্চ মহলে, বুদ্ধিজীবী মহলে পর্যাপ্ত গুরুত্বসহ নেয়া হয় এটা একরকম প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর গৌতম ঘোষ নিজেও এমনটি জানেন বলেই হয়তো এবার কোনো ধরনের অ্যাডাপটেশনে না গিয়ে নিজের একটি মৌলিক অথচ ‘উদ্ভট’ ও যুক্তিহীন গল্পের একটা সিনেমা নিয়ে পরম আশাবাদী হয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশে!

gowtom ghosh

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কাঁটাতার বিষয়ক জটিলতার মত স্পর্শকাতর গল্প নিয়ে নির্মিত ‘শঙ্খচিল’ নামের সিনেমাটি বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকদের খাওয়াতে পরম আশাবাদী হয়ে গত ১২ এপ্রিল গৌতম ঘোষ ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে। সেদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎসহ বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকেরা! আর সেখানেই এলিট মানুষের সাথে এলিট একটা ভাব নিয়ে দেখা ফেলা গেল ছবিটি! এবং কাকতালীয়ভাবে নির্মাতা গৌতম ঘোষের পাশে বসেই! না না, এক হল রুমের কথা বলছি না, সত্যি সত্যিই একেবারে পাশাপাশি বসে!ফলে সিনেমায় যে জায়গাগুলোকে তিনি ‘কি পয়েন্ট’ মনে করেছেন, এবং ঘাড় উল্টিয়ে হলভর্তি দর্শকদের দিকে বারবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করেছেন সে বিষয়গুলো বিশেষ নজর কেড়েছে।

সীমান্তে নিহত আলোচিত বাংলাদেশের মেয়ে ফেলানির মত কাঁটাতারে ঝুলে থাকা একটা লাশের দৃশ্যের মাধ্যমে শুরু হয় সিনেমা। তার আগে চোখ আটকে ছবিটি যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে, মানে ঋত্বিক ঘটকে! যে মানুষটি ভেতর থেকে মেনে নিতে পারেননি বাংলাদেশ-ভারতের ভাঙন। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঘটকের যে ক্ষত তার হৃদয়ে তৈরি হয়ে ছিল তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে সেই প্রমান তিনি রেখেছেন! মেঘে ঢাকা তারা থেকে যুক্তি তক্কো গপ্পো কোথায় নেই ঋত্বিকের দেশ ভাগের রক্তাক্ত দহন!

শঙ্খচিল

সিনেমা দেখার আগেই প্রচুর সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জেনেছি যে ছবিটি দেশভাগের গল্প নিয়ে নির্মিত। তারমানে ১৯৪৭ সালের সেই বুড়ো খুকোদের ভিমরুতির গল্প, আবার ইতিহাস, আবার পুরনো কাসুন্দি! কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়েছিল এতদিন পরে গৌতম ঘোষ কেনই বা দেশভাগ নিয়ে সিনেমা বানাবেন? দুই দেশের ভাঙন নিয়ে দীর্ঘদিন পর গৌতম ঘোষের হঠাৎ মন কেঁদে উঠার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই সেদিন মনে মনে খারিজ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সিনেমায় যখন দেখলাম ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক বয়ান নয় বরং দেশভাগত্তোর সময়ের গল্প শঙ্খচিল। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ের সীমান্ত এলাকার গল্প ‘শঙ্খচিল’-এর প্রেক্ষাপট। এমন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গৌতম ঘোষের সিনেমা বানানোর কারণ চাইলে সিনেমা শেষে একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার দখলের একটি নয়া কৌশল।’ ভদ্রলোকের এমন কথায় পাত্তা না দিলেও বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ-কলকাতার সিনেমা আমদানি-রপ্তানি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে গৌতম-প্রসেনজিতের দৌড়ঝাঁপও কথা মনে পড়লো। সেবার বাংলাদেশের নির্মাতা ও শিল্পগোষ্ঠির বাধায় সুবিধা করে উঠতে পারেনি গৌতম, প্রসেনজিৎ ও মমতা গং!

যাইহোক, গৌতমের শঙ্খচিলে ফিরি। মানবিক একটা গল্প বলার মধ্য দিয়ে গৌতম তার সিনেমায় ধর্ম, রাজনীতি দেখাতে যেয়ে কি একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেন। শঙ্খচিলের আগের ছবি শুণ্য অঙ্কতেও এমনটিই আমরা দেখেছি। আর এই ছবিতে জগাখিচুড়ি লাগালেন সীমান্তের মত জটিল, সংবেদনশীল ও রাজনৈতিক ছবির গল্পকে একটি মানবিক গল্প হিসেবে তুলে ধরার সরল ছেলেমানুষি করে! যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই।

সীমান্তকে সিনেমার বিষয়বস্তু করায় গৌতম ঘোষের শক্তপোক্ত কোনো যুক্তি পুরো সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্তত আমি পায়নি। তাই নিজেই বাধ্য হয়ে শঙ্খচিল সিনেমাটাকে গত বছরে বলিউডে মুক্তি পাওয়া ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যানের’-এর ক্রাইসিসের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলাম! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত কেতন মেহতার ওই ছবিটি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয় ছবিতে ‘পাহার’কে একটা ফ্যাক্ট মনে করেন। ঠিক সেই ছবির মত গৌতমের শঙ্খচিলে প্রধান বাধা দুই দেশের ‘কাঁটাতার’। মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’-এ দশরথ মাঝি বাস করতেন পাহারি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই বাস করেন তিনি। কিন্তু একদিন পাহার থেকে পরে গিয়ে মারাত্মাক আহত হন তার স্ত্রী। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিশাল এক পাহারের পেছনেই বড় হাসপাতাল, কিন্তু স্ত্রীকে পাহার ডিঙিয়ে নিয়ে যাওয়াতো সম্ভব না। সব ঘুরিয়ে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায় তার স্ত্রী। যদি বিশাল এই পাহারটা না থাকতো তাহলে হয়তো স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারতো, এই ক্ষোভ ঝেঁকে বসে বসলে প্রায় ২২ বছর টানা পাহার কেটে রাস্তা বানিয়ে ফেলেন দশরথ মাঝি। ঠিক এমনি সেম্পটমের দেখা মেলে ‘শঙ্খচিল’-এ মুনতাসির বাদল চৌধুরী নামের এক স্কুল মাস্টারের জীবনে। দশরথ মাঝির মত তার জীবনে বাধা হয়ে আসে দুই দেশের কাঁটাতার।

chk_captcha

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে রূপসাকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই নদী তীরবর্তি এলাকায় বাস করেন বাদল মাস্টার। মাস্টারের সব স্বপ্ন মেয়ে রূপসাকে ঘিরেই। মেয়ের মুখের হাসির জন্য সব করতে পারেন তিনি। মেয়ে চারদিকে হাসি খুশিভাবে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ের সমস্ত ছেলেমানুষিকেও আস্কারা দেন বাদল মাস্টার ও স্ত্রী লায়লা। এরইমধ্যে ভারতীয় সীমান্তের এক বিএসএফ সৈনিকের সঙ্গে পরিচয় হয় রূপসার। নিজের মেয়ের সঙ্গে রূপসার চেহেরার মিল থাকায় ওই জোয়ানটি তাকে মিষ্টি বলে ডাকে। এভাবেই সীমান্ত পাড়ের একটি পরিবার সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রূপসা। মেয়েকে নিয়ে চরম সংকট আর ভয়াবহ প্রশ্নের সামনে পতিত হয় বাদল মাস্টার। এতটুকু মেয়ের হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। শিগগিরই চিকিৎসা করতে হবে, তা না হলে কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। বাদল মাস্টার পড়েন মহা সংকটে। ভালো চিকিৎসার জন্য এই সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে দ্রুত সময়ে খুলনা কিংবা ঢাকা শহরে যাওয়ারও সময় নেই! তাই তার স্কুলের হিন্দু প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে খুলনা কিংবা ঢাকা নয়, তার দ্রুত সময় আর ভালো চিকিৎসার জন্য জীবনের রিস্ক নিয়ে অবৈধভাবেই সীমানা পাড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভারতের টাকি যায় বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী। যেখানে বাদল মাস্টারের বন্ধু তাদের দায়িত্ব নেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকিতেও হয়ে উঠে না রূপসার চিকিৎসা। তার হার্টের বাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কলকাতায় গিয়ে অপারেশন করানো ছাড়া আর কোনো গতন্ত্যর থাকে না। সেখানে গিয়েও বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী পড়েন মহা সংকটে। মুসলিম ধর্মের হয়েও শুধুমাত্র মেয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতার সুরম্য হাসপাতালে তাদেরকে হিন্দু নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়! এখানেও অস্তিত্বহীনতার আরোপিত সংকট দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন গৌতম ঘোষ।

ধর্ম নাহয় পরিবর্তন করে কলকাতার হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করলেন বাদল মাস্টার, কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি? তারও ব্যবস্থা করেন টাকির ওই দাদু, যার ভরসায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছেন বাদল মাস্টার। ভারতীয়দের এমনসব মহানুভবতা পুরো সিনেমায় হর হামেশায় দেখা মেলে। শেষ পর্যন্ত টাকার ব্যবস্থা হলেও মারা যায় রুপসা। মেয়ের মৃত্যুর পর ব্যাপক ক্ষোভে অবৈধভাবে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়ে আসার কথা বলে দেয় বাদল মাস্টার। ফলত তাদেরকে অবৈধ অভিবাসি আখ্যা দিয়ে ভারতীয় জেলে পুরে মেয়ে রুপসার মৃত লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর রূপক হিসেবে গৌতম ঘোষ দেখান যে, বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু শঙ্খচিল ভারতের সীমানায় উড়ে যাচ্ছে…

Shongkhachil

মূলত ছবির গল্প এতুটুকু। কিন্তু এই গল্প দিয়ে গৌতম ঘোষ কি বুঝাতে চাইলেন আসলে? সীমানা তুলে দেয়ার গল্প বললেন? মানবিকতার গল্প বললেন? নাকি এই ছবির বাদল মাস্টারের মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চাইলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্য হাহাকারটা শুধুই বাংলাদেশের মানুষের! ভারতের মানুষ আনন্দে আছে, ওইখানে মেলা হয়, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, সেখানের মানুষগুলো মহানুভবতায় ঠাসা, এইসব? পুরো সিনেমাতেইতো এমন দাদাগিরিটা টিকিয়ে রাখলেন গৌতম ঘোষ? এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে অসংখ্য বাংলাদেশির মৃত্যুর বিষয়টিকেও পা মাড়িয়ে গেলেন তিনি।

এই যেমন, সিনেমার প্রথমেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে যে বাংলাদেশির মৃত্যু হয় তার খুনের দায় বিএসএফ নিজের ঘাড়ে না নিয়ে বরং ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দিয়ে সাফাই গাইতে শুনি। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যখন খুনের দায় কার? কিংবা সীমান্ত হত্যার দায়তো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদেরই বলে জিজ্ঞেস করেন, তখন সীমান্ত প্রধানকে আমরা বলতে শুনি ‘এই খুনের দায় কোনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর না, বরং ব্লাডি হিস্টোরি’র!’

আহা, কতো চমৎকার উত্তর এই উচ্চপদস্ত কর্মকরতার! একেরপর এক ফেলানীর মত মানুষকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখবে ভারতীয় জোয়ানরা, আর তাদের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ক্ষোভ দেখিয়ে ইতিহাসকে গালাগাল করে চুপ মেরে যাবেন! কি হাস্যকর, আর মর্মান্তিক যুক্তি! বাস্তবেও কি তাহলে প্রত্যেকটা বাঙালির সীমান্ত দিতে গিয়ে খুন হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা এমনই ইতিহাসের উপর দায় চাপিয়ে দিয়েছেন, বা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ। এই দেশের মানুষের চেয়ে হয়তো ভারতের মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ সুবিধা বেশি পায়। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কেউ কেউ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় জীবনকে মুঠোবন্দি করে রাতের অন্ধকারে ভারত পাড়ি দিতে চায়। কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলানোর ঘটনায় কোনো রকমের তোয়াক্কা না করে, জবাবদিহিতার ধার না ধেরে বরং উল্টো সেইসব সীমান্তের খুনকে বৈধতা দেয়ার জন্য গৌতম ঘোষের মত নির্মাতারা সিনেমাকে ব্যবহার করতে পারেন না। এটা অন্যায়। এসব স্পর্শ কাতর বিষয় নিয়ে এমন সরল ছেলেখেলা বড়ই নির্মম। অন্তত আমাদের জন্য।

বাংলাদেশের দর্শকদের খুশি করার জন্য কলকাতার ভালো মন্দ দুই শ্রেণির মানুষকে দেখানোর মত হাস্যকর ব্যালেন্সও করেছেন গৌতম ঘোষ। এই যেমন কলাকাতায় মেয়ে রূপসার চিকিৎসা বাবদ ব্যয়ের জন্য বাদল মাস্টার তার স্ত্রীর গয়না বিক্রি করার টাকা যখন এক ধান্দাবাজ ভাগিয়ে নিতে চাইল সেই মুহূর্তটি, এবং কিছু মানুষ পরম মমতায় কলকাতার রাস্তা থেকে তাদের উদ্ধার করলো। এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে কলকাতার রাতের রাস্তায়ও হোন্ডাওয়ালা তরুণদের দৌরাত্ম দেখানোর শটটি একেবারেই বেমানান ছিল।

কিছু দৃশ্যমান অসঙ্গতি ছিল, যা চোখে বেশ দৃষ্টিকটু। এই যেমন পুরো সিনেমায় দর্শক জেনে এসেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় শুধু কাঁটাতার দিয়ে বিভাজন। রূপসাকে (সাঁঝবাতি) মাঝে মধ্যে দেখাও গেছে কাঁটাতারের ফাঁকা দিয়ে ভারতীয় সেই জোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মূল সংকটটা যখন সিনেমায় শুরু হলো, মানে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রূপসার চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছিলেন বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী, তখন দেখা যায় দুই দেশের সীমানা মানে মাঝখান দিয়ে একটা নদী!

পুরো ছবিতে অভিনয়ে সবাই নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন বলে মনে হয়। যদিও রূপসা চরিত্রে সাঁঝবাতির অভিনয়ই বেশি প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রত্যেকের অভিনয় ইন্টেনশনাল একটা সিনেমার প্রেক্ষাপটের কাছে ম্লান হয়ে গেল! এক ধরনের আরোপিত ট্র‌াজেডি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সিনেমার সমাপ্তির চেষ্টাও তাই বৃথা গেল।

দুটো বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সীমানা, প্রাচীর, কাঁটাতার তুলে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে ফ্যান্টাসাইজ করে শঙ্খচিলে মানবিক গল্প পরিবেশন করার যে কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন তার সিনেমায় তা ইতিমধ্যে অন্তত বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে যথেষ্ঠ হাস্যখোরাকের জন্ম দিয়েছে। তাই খুব সরলভাবেই বলা যায়, সীমানা নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের যে ক্ষত আর গৌতম ঘোষের যে ইন্টেনশন তা এক নয়। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঋত্বিকের হৃদয়ের ক্ষত শুধুমাত্র গৌতমের মত আলগা আবেগ দিয়ে মোড়ানো নয়। গৌতম ঘোষ ভালো নির্মাতা। কিন্তু সেই ভালো নির্মাতার প্রশংসাটা তিনি কালবেলা, পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা মনের মানুষের জন্য পাইতে পারেন, শঙ্খচিলের জন্য নয়।

আ লিটিল এলিজি ফর ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’/নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

প্রথমে আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কী নই আর তাহলে আমি কী। আমি ফেমিনিস্ট নই, আবার ইনটেনশনালি সেক্সিস্টও নই— ইনফ্যাক্ট আই অ্যাম দ্য ম্যাঙ্গো পিপল। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ ভালো সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তথাপি মনে হয় সিনেমা বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই কম, তাই বিশেষ তাত্ত্বিক কোনো আলোচনায় আমি যাবো না। জানি, বোদ্ধা ও দর্শকবর্গ এই সিনেমা নিয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন। এর মধ্যে বলেছেনও। যদিও ভালো বলার একশো তেরোটা কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি তেমন ভালো কোনো কথা বলবো না বলে ঠিক করেছি। তাই আমি নিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছি।
under_construction
সিনেমার নাম ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’। শুরুতেই খানিকটা কাহিনি সংক্ষেপে বলে নিই। রয়া একজন থিয়েটারকর্মী। বারোবছর ধরে মঞ্চে রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন তিনি। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় দলনেতা রাসেলভাই চরিত্রটিতে আরেকজনকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তরুণীরাই কেন শুধু নন্দিনী হতে পারবে এ প্রশ্ন ঘুরে মরে রয়ার মনে। সেই সময় ইন্ডিয়া থেকে ইমতিয়াজ নামের একজন নাট্যদলের অধিকারী আসেন। এসে নতুনভাবে ‘রক্তকরবী’কে মঞ্চে তোলার পরিকল্পনা করেন। রয়ার সঙ্গে তখন তার এক ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। একই সময় রয়ার কাজের মেয়ে ময়না লিফটম্যান সবুজমিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে কনসিভ করে। ফলত ময়না রয়ার ঘর ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে ওঠে। এবং সে গার্মেন্টস এ কাজ নেয়। এর মধ্যে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আর রয়ার তখন ঢাকা শহরকে রক্তকরবীর যক্ষপুরীই মনে হয়। তখন রক্তকরবীকে এইসব পেক্ষাপটে বিনির্মাণের চিন্তা তার মাথায় আসে। মূল কাহিনি মূলত তখনই থেকে শুরু হতে থাকে।
cover 02
এই সিনেমার প্রধান চরিত্র রয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাহানা গোস্বামী। তাকে ইতঃপূর্বে আমার ভালো লেগেছে সালমান রুশদীর উপন্যাস নিয়ে দীপা মেহতার বানানো সিনেমা মিডনাইট্স চিলড্রেনে মুমতাজ ও আমিনা চরিত্রে। ময়না চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিকিতা নন্দিনী, রয়ার মায়ের চরিত্রে মিতা চৌধুরী, আর ইমতিয়াজ চরিত্রে রাহুল বোস। রয়ার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করছেন শাহাদাত হোসেন। রাসেলভাই চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম। এছাড়া সোহেল মণ্ডল, স্পর্শীয়া নওশাবা আহমেদ সাবা প্রমুখ। সংগীত পরিচালক অর্ণব। নেপথ্য কণ্ঠ শাহানা বাজপেয়ী। ক্যামেরায় ছিলেন মার্টিন রডওয়ান। এডিটিং সুজন মাহমুদ। খনা টকিজ প্রযোজিত ও নিবেদিত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা রুবাইয়াত হোসেন। এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন দেখতে বসে প্রথেমেই সিনেমাটির প্রধান চরিত্র রিহার্সেলরত রয়ার নাভীর গভীরতায় আর মখমল পেটের ভাঁজে আমার চোখ আটকে গেলো। সে আয়নার সামনে নিজে নিজে রক্তকরবী নাটকের রিহার্সেল করছিলো। ধাক্কাটা এইভাবে খেলাম। ধাক্কা খাওয়ার কারণ ফেমিনিস্ট সিনেমা ভেবে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম। আর তাছাড়া নারীত্ব বিষয়টা পুরুষত্বের মতো শারীরিক কোনো বিষয় নয়। মানে নারীত্ব ব্যাপারটা শরীর নয়, এটা অনেকাংশে ব্যক্তিত্বের রূপায়ন। এটা পিতৃতান্ত্রিক/সামাজিক কাঠামোর কারণে নারীদের মাথায় ধীরে ধীরে তৈরি হয়। যেমন কোমল আর অবলার ধারণা তৈরি হয়। আর আমরা দেখেছি রয়ার অভিব্যক্তিতে কিন্তু শরীর দেখানোর বিষয়টা ছিলো না। থাকলে বিষয়টা অবান্তর আর সংলগ্নতাহীন মনে হতো না। ক্যামেরার ফোকাসিং এরও একটা বিষয় আছে। তারমানে এইখানে পরিচালকই রয়ার শরীর দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ইতঃপূর্বে ঋতুপর্ণ ঘোষের আবহমান সিনেমায় অনন্যা চ্যাটার্জিরও রিহার্সেলের দৃশ্যও আমরা দেখেছি। ওইদৃশ্য দেখে আমাদের মধ্যে এই রকম ধাক্কার সৃষ্টি হয় নাই। নন্দিনী তো একটা শক্তির নাম। সে তো শরীর নয়। আমি ছোটোবেলা থেকে রক্তকরবী অজস্রবার পড়েছি, অনেক মঞ্চে দেখেছি একবারও নন্দিনীকে শরীর মনে হয়নি, রুবাইয়াতের সিনেমা দেখে প্রথম মনে হলো।
কদিন আগে সিনেমাটির বিশেষ প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপনে দেখি কেবল নারীরা ফ্রি দেখতে পাবে। মনক্ষুণ্ণ হলেও মনে হলো সিনেমাটা মনে হয় নতুন কিছু হবে, ফেমিনিস্ট কোনো কিছু। কারণ রুবাইয়াত হোসেনের পূর্ববর্তী ছবি মেহেরজানের কাহিনিতে পলিটিকাল ইনটেনশন থাকলেও মেকিং ভালো ছিলো। তাছাড়া এইবার এবাদুর রহমান নাই জেনে ভাবলাম সিনেমা ভালোই হবে। কারণ মেহেরজানের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের একজন ছিলেন এই এবাদুর। আমাদের মনে আছে, মেহেরজানে পাকিবাহিনি থেকে পলাতক সৈনিকের প্রতি বাঙালি নারীর গদগদ প্রেম দেখিয়েছিলেন রুবাইয়াত। এবং তা আরোপিতই মনে হয়েছিলো তখন। তারপরও ভাবলাম, আন্ডার কনস্ট্রাকশনটা মুক্তি পেলে দেখবো নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রিমিয়ারেই দেখে এসে লিখতে বসলাম। সিনেমা ভালো হয়েছে, নিখুঁত মেকিং। আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন, ডায়ালগ থ্রোয়িং, ফ্রেইমিং, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়, সর্বোপরি এডিটিং ও মেকিং খুবই ভালো। বিশেষভাবে বলতে গেলে খুবই গভীর ভাবনা-চিন্তা আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন ইত্যাদিতে কাজ করেছে।
cover 02
কিন্তু ধাক্কাটা আমার জায়গা মতোই লাগলো। এরপর পুরো সিনেমাজুড়ে রয়ার শরীর দেখতে দেখতে, শরীরের উৎফুল্ল বাঁক দেখতে দেখতে সেই ধাক্কা কম্পনে পরিণত হলো। আমার মনে হলো প্রকৃত অর্থে, একটা সিনেমায় পরিচালক যা দেখাতে চান প্রধানত আমরা ম্যাঙ্গো পিপল তাই-ই দেখি। আর যা দেখাতে চান না সেই পাঠক্রম অন্যত্র বা উচ্চমার্গীয় দর্শকের জন্য।
রয়ার মা বলেন যে, তিনি স্বামীর টাকায় ফুটানি মারেন না। এইটা একটা সত্য কথা। এবং মেয়ের প্রতি মায়ের এই ঘা দেয়াটা আমার ভালো লাগে। যা তাকে জাগাতে সাহায্য করে। রয়াতো প্রকৃতঅর্থে স্বামীর টাকাতেই ফুটানি মারে, ময়নাকে দামি গয়নাগাটি উপহার দেয়। উন্মূল ময়নাকে গার্মেন্টসে কাজ করতে দেখে তারমধ্যে নারীবাদী চেতনা জেগে উঠে কিন্তু নিজেকে উন্মূল করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রয়া বড়লোকের বউ হয়ে সুবিধা নিতে পারে, কিন্তু বারো বছর মঞ্চে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয়ের পর তেত্রিশবছর বয়সেও ক্যারিয়ারের বিপরীতে সন্তানের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। তার স্বামীর সন্তান কামনাটাকে আমার কাছে অতি চাওয়া মনে হয় না কিংবা অনধিকারও মনে হয় না।
সন্তান তার কাছে তার ক্যারিয়ারের অন্তরায় মনে হয় কিন্তু পেটের ওপর থেকে ময়নার গর্ভস্থ শিশুর পায়ে হাত বুলিয়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও তার মধ্যে সন্তানের জন্য আকুতি তৈরি হতে দেখি।
যথারীতি সেই একই ট্যাবু, একই টাইপের মধ্যেই আটকে থাকার বিষয় প্রদর্শন করেন পরিচালক। যেমন, পাখির খাঁচার পরিবর্তে আমাদের দেখান জারের মাছ। পুরুষ ইমতিয়াজকেই দেখা যায় উদ্ধারকর্তা হিশেবে। যেমন, আবহমান কাল ধরে পুরুষই পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
গর্ভবতী কাজের মেয়ের পা কোলে নিয়ে নূপুর পরিয়ে দেয়ার বিষয়টা ঔচিত্যবোধের বাসনার রূপই হয়তো রুবাইয়াত হোসেন আমাদের দেখিয়েছেন। কিছু কিছু দৃশ্য দেখে মনে হয় এই সিনেমা আসলে নারীদের কী করা উচিত তার বিবরণ।
একা লাগে কিনা এহেন পারস্পরিক প্রশ্নে ইমতিয়াজ যখন রয়ার হাতের আঙুল স্পর্শ করে তখন পর্যন্ত ঠিক লাগে, কিন্তু ইমতিয়াজের আঙুল যখন রয়ার ওষ্ঠাধরে আরোহণ করে তখন মাথার মধ্যে দার্শনিক ভাবনা আসে, আমরা ভাবি নৈসঙ্গের আদি কারণ কাম। একই প্রশ্নে একই দৃশ্য আমরা পৃথিবীর আরো শখানেক সিনেমায় দেখেছি। অনেকে বলবেন রয়া অভ্যস্তার কামে ক্লান্ত। কিন্তু অভ্যস্ততার কামে ক্লান্তির জন্য পারস্পরিক দায়ের একটা ব্যাপার থাকে। হোয়াটএভার, কাহিনি সেটা নয়, কাহিনি হলো ইমতিয়াজ যখন বলে আমার একা লাগে কিন্তু ‘আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক’ এই জাতীয় কথা—তারপরে আঙুল থেকে ওষ্ঠাধরে আঙুল গেলে যে পরিণতির দিকে যায় তা এর সিকোয়েন্স হতে পারে না আর কি। এটা তখন পরিচালকের আরোপ মনে হয়। কারণ ইতঃপূর্বে প্রায় কাছাকাছি দৃশ্যে অপর্ণা সেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার সিনেমায় রাহুল বোসকে কেমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাও আমাদের মনে থাকার কথা। সুতরাং আমার আরো একবার মনে হলো পরিচালক যা দেখাতে চান আসলে আমরা তাহা-ই দেখি। মূলত ফোকাসিত শরীর আর আঙুলের পরিণতি আন্ডার কনস্ট্রাকশনের লাইনের বাইরে চলে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। রয়ার লক্ষ্যের এবং পথচলার মাঝখানে এই ব্যাপারটাকে (ইমতিয়াজের এই রূপ এবং রয়ার অনুমোদন) আমার কাছে একটা ধ্বংসযজ্ঞ মনে হয়। মনে হয় এই ব্যাপারটা সিনেমাটার উদ্দেশ্যটাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
কর্মক্লান্ত স্বামীর সঙ্গে নিষ্পৃহ শৃঙ্গারও ইতঃপূর্বে আমাদের দেখা। পাশের বালিশে শায়িত সাপ, গৃহস্থ স্বামীর এই সাপরূপ, এইরূপ ভয় দর্শনও আমাদের পূর্বপরিচিত, যেমন পরিচিত বাথটাবের পানিতে স্নানের সময় সাঁতরে বেড়াচ্ছে শামুক, কচ্ছপের বাচ্চা এইসব। জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু লোকটির সারাদিন টিভি সেটের সামনে বসে থাকা, নিউজচ্যানেল দেখাও আমাদের অনেক সিনেমায় দেখা হয়েছে। সিনেমার স্বপ্ন দৃশ্যগুলির মতো দৃশ্যও আবহমান বিশ্বের সুররিয়ালিস্ট সিনেমাগুলিতে অহরহ দেখা যায়।
তবে রক্তকরবী নাটকের ইপ্রোভাইজেশনের চেষ্টার বিষয়টা আমার কাছে তাও খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে। আরো খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে গ্রিনরুমের আয়নায় নন্দিনী রয়ার খুলে রাখা টিপ আয়নার সামনে দাঁড়ানো নতুন নন্দিনীর কপালে প্রতিস্থাপনে যে মনতাজ তৈরি হয় সেই বিষয়টা। তবে এই মেয়েটিকে দেখে আমাদের কলকাতার শৈবাল মিত্রের শজারুর কাঁটা সিনেমার কঙ্কনা সেন এর স্থলাভিষিক্ত নতুন নন্দিনীর সেইসব অনাত্মবিশ্বাসের কথাই মনে পড়ে যায়।
একটা হুজুরদের মিছিলের দৃশ্যে, ‘নাস্তিকদের হত্যা কর’ স্লোগান ঠিকই ছিলো। সিনেমাটা যে সময়ের পেক্ষাপটে বানানো ওইসময় রাজপথে এই ধরনের মিছিল ছিলো, এখনো আছে। মিছিল দেখে সিএনজি অটোরিক্শার ভিতর ভীত রয়ার মাথায় কাপড় দেয়াটাকে বা হাত ঢেকে ফেলাটাকেও আমার কাছে স্বাভাবিক এবং বাস্তব মনে হয়েছে। কারণ এহেন মিছিল থেকে হামলার রেকর্ডও আছে।
সিনেমার নামকরণও যথারীতি সার্থক। রয়া আন্ডার কনস্ট্রাকশনেই ছিলো শেষ পর্যন্ত। শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় সে একদিন নিজের পায়েই দাঁড়াবে।
শেষপর্যন্ত সিনেমাটা কথিত প্রগতিশীল এলিটদের বিনোদনের পপকর্ন আর পেপসি জুগিয়েছে বলা যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটা অনেকটা চুরি করে স্নানরত আদিবাসী নারীদের স্তনদলের অথবা স্তনদানরত ভিখিরিনীর ফটো উঠিয়ে আর্ন্তজাতিক পুরস্কার জিতে নেয়ার মতোই।
মোটামুটি শেষ কথা হলো, রুবাইয়াত হোসেন ডিরেক্টর হিশেবে খুবই স্মার্ট। এই বাঙলা সিনেমার আকালে তার আরো সিনেমা বানানো উচিত। আমরা দেখতে চাই। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি তাই এতো সমালোচনা করে ফেললাম, এতো খুঁত বের করে ফেললাম। আশা রাখছি, আগামীতেও করবো ইনশাল্লা।

সালমান শাহ: যে বাঁশি ভেঙে গেছে/ হাসনাত শোয়েব

 

‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে তারে কেন গাইতে বল?

কেন আর মিছেই তারে সুরের খেয়া বাইতে বল?’

১৯৯৬ সালে আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। সে বয়সের স্মৃতি মনে থাকাটা স্বাভাবিক না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার তেমন কিছু মনে নেই। শুধু ঝাপসা ঝাপসাভাবে দুটি ঘটনা কেবল মনে করতে পারি। এক শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জয়। আর দুই সালমান শাহ’র মৃত্যু। অর্থ্যৎ ক্রিকেট বিশ্বে নতুন তারকার উত্থান এবং বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নক্ষত্রের পতন।

salman-edit Cover 01

সালমান শাহর মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের শিল্পের জন্য কতটা ভয়াবহ ছিলো তা সালমানের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দিকে চোখ ফেরালেই বুঝা যাবে। সালমানের মৃত্যু চলচ্চিত্র শিল্পে অদ্ভুত এক স্থবিরতা এনে দিয়েছিলো। যেনো কারো কিছু করার নেই। সালমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ওমর সানীও কোন এক অজানা কারণে সিনেমা থেকে দূরে সরে গেলেন। ফেরদৌস-রিয়াজরা এসে সেই হাল ধরার চেষ্টা করলেও ততদিনে দর্শকও কেমন জানি ম্যানিয়াক হয়ে গেলো। তারপর চলচ্চিত্রকে চালানোর জন্য কাটপিসের আমদানি করতে হলো। এক শ্রেণির দর্শক তাতে সাড়া দিলেও মধ্যবিত্ত দর্শকের বৃহত্তর অংশ হা-পিত্যেস করতে করতে বাংলা সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো। ঐ সময় একমাত্র মান্নাই মূলত নিম্নবর্গীয় দর্শককে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। যা ক্রমান্বয়ে তাদের মাঝে মান্নাকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিলো। মান্নার মৃত্যুর পর তার জানাজায় মানুষের ঢলই বলে দিয়েছিলো তাদের কতটা কাছে ছিলেন তিনি। কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে সিনেমাকে নিয়ে যাওয়ার অথবা দর্শককে সিনেমার কাছে নিয়ে আসার কোন কাজই সিনেমার কুশীলবরা তখন করতে পারেন নি।

মূলত আশির শেষ এবং নব্বই শুরু থেকেই বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায়ীক দিক থেকে তুঙ্গে অবস্থান করছিলো। ঐ সময়ের চলচ্চিত্রের অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাতকারে সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী বলছেন, দর্শক সে সময় মূলত চারভাগে বিভক্ত ছিলো। এক ভাগে ছিলো রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনরা, দ্বিতীয় ভাগে ছিলো রুবেল, তৃতীয় ভাগে ছিলো শাবানা। আর অন্য ভাগে ছিলাম আমি (ওমর সানী) আর সালমান।

ওমর সানীর এই কথা ধরে বলা যায় ঐ সময় বেশিরভাগ নায়ক-নায়িকারা নিজেদের জন্য দর্শক শ্রেণী তৈরি করতে পেরেছিলো। যা সে সময় সব শ্রেণীর দর্শককে হলে নিয়ে আসতে পেরেছিলো। তাই ব্যবসায়ীক দিক থেকেও চলচ্চিত্রগুলো সফলতা পেয়েছিলো।

কিন্তু এসব কিছুর পরেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে সালমানের আগমন একটা টার্নিং পয়েন্ট বটে। সালমান মূলত গতানুগতিক ধারাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। সালমান মোট অভিনয় করেছেন ২৭ টি ছবিতে। যার মধ্যে মাত্র তিন কি চারটি ছবি ব্যাবসায়ীকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো। এমন কোন এক্সপেরিমেন্টাল ছবিতে অভিনয় করেন নি তিনি। সবই ছিলো সামাজিক ঘটনা নির্ভর ছবি। প্রেম-সামাজিক অবক্ষয়- গুড ভার্সেস এভিলের লড়াই, ধনী-গরীব বৈষম্য এবং অবশেষে হ্যাপি এন্ডিং। এসব ডিসকোর্সের মধ্যেই সিনেমার মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছিলো। তবে তখনকার নায়করা সিনেমার শেষে মরতে না চাইলেও সালমান বেশ কয়েকটি ছবিতে মরার সাহস করেছিলেন। তিনি তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ এ মৃত্যুর দৃশ্যে অভিনয় করার সাহস দেখিয়েছিলেন। শুধু সালমান না, ঐ সিনেমার নায়িকা মৌসুমীও মরেছিলেন তার সাথে।

সালমান নিয়ে বলতে গিয়ে সানীর ভাষ্য, ওই সময়ে সালমান ছিলো স্টার। কিন্তু মৃত্যুর পর দর্শক তাকে সুপারস্টার বানিয়েছে। অর্থ্যাৎ সানীর কথা যদি সত্য ধরে নেই তবে মৃত্যু সালমানের জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়িয়েছে, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা সে হারেই কমিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো একটি স্টেরিওটাইপ ধারার মধ্যে সালমান এমন কী করেছিলেন যা তাকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো? সালমান প্রথমত নিজেকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তিনি হয়তো আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম স্টাইল আইকন। কখনো পনিটেল, কখনো কাউবয় হ্যাট আবার কখনো অভিনব গগলস। পোশাকেও নতুনত্ব এনেছিলেন সালমান। এসবই তাকে মধ্যবিত্ত বাঙালি তরুণদের কাছে আইডল এবং তরুণীদের কাছে স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো। যাদের কেউ কেউ সালমানের মৃত্যুর পর আত্মঘাতী হয়েছিলো। আর যারা বেঁচে ছিলেন তারা এক রহস্যময় অভিমান নিয়ে সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো।

Poster Compile

সালমান মূলত মধ্যবিত্তের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেই চরিত্র, যাকে মধ্যবিত্ত তাদের আপন ভাবতে পেরেছিলো। অনেক দূরের হয়েও যিনি ছিলেন খুব কাছের। বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফির জনপ্রিয়তাকে হয়তো সালমানের জনপ্রিয়তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যারা সুপারস্টার হওয়ার পরও মধ্যবিত্তের কাতারে শামিল হয়েছেন অতি সাধারণ একজন কাছের মানুষের মতো । এখানে অন্যান্য তারকাদের চেয়ে এক ধাক্কায় আলাদা হয়ে যান তারা।

অভিনয়েও সালমান ছিলেন সাবলীল। যেকোন ধরনের চরিত্রের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অসামান্য এক গুণ ছিলো তার। তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখে কেউ বলবে না এটা তার প্রথম ছবি। মনে রাখা দরকার এই একই চরিত্রে অভিনয় করে অভিষেক হয়েছিলো বলিউড সুপারস্টার আমির খানেরও। কিন্তু দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলে বলা যেতে পারে তর্কযোগ্যভাবে সালমানের অভিনয় আমিরের চেয়ে ভালো ছিলো। এছাড়া ‘বিক্ষোভ’এর দেশপ্রেমিক যুবক, ‘আনন্দ অশ্রু’র পাগল খসরু, ‘মায়ের অধিকার’র রাগী যুবক অথবা ‘তোমাকে চাই’র প্রেমিক যুবক। সব চরিত্রেই সহজাত অভিনয় করে দেখিয়েছেন সালমান।

তবে তার সময়ের বা তারও আগের অন্য নায়কদের চেয়ে সালমানের পার্থক্য হলো সালমান সচেতন বা অবচেতনে ‘মেলোড্রামা

‘কে নিজের অভিনয় থেকে বাদ দিতে পেরেছিলেন। অথচ একই ধরনের কাহিনীর মধ্যেই অন্যরা বেশিরভাগ সময় তাল রাখতে পারেন নি। সালমানের আগে এই কাজটি সম্ভবত রাজ্জাক এবং কিছুটা পেরেছিলেন আলমগীর।

আগেই বলেছি সালমানের সিনেমা ‘আলাদা’ কিছু  বলে নাই। ওই সময়ের আর দশটা জনপ্রিয় ধারার সিনেমার মতোই সালমানের ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সালমানের বয়ান ভঙ্গিমা ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। পরিমিতিবোধ, প্রেজেন্টেশন, স্টাইল এবং সালমানের স্বকীয়তা সেইসব সিনেমাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সালমান ছিলেন অভিনেতা। যেটুকু চরিত্র পেয়েছেন সেখানে নিজের রঙ ঢেলে দিয়েছেন। আজ যখন মেইনস্ট্রিম সিনেমার বাইরে গিয়ে অনেক নির্মাতা কাজ করছেন তখনই সালমানের অভাব আরো বেশি বেশি অনুভব হচ্ছে। পশ্চিম বাংলার নায়ক প্রসেনজিতের দিকে তাকালেই তা বুঝা যায়। এক সময়ের বানিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় এই নায়ক মেইনস্ট্রিমের বাইরে গিয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সালমানও নিঃসন্দেহে সে জায়গায় পৌছতে পারতেন অনায়সে। কিন্তু মৃত্যু সেসব সম্ভাবনার গায়ে নোকতা বসিয়ে দিয়েছে।

শুধু চলচ্চিত্রে না, বাংলা নাটকেও সালমান তার স্বকীয়তা দেখিয়েছেন। অভিনয় জীবনে মোট ৮ টি নাটকে অভিনয় করেছেন সালমান। এর মধ্যে ‘নয়ন’ তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের যখন তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি নয়নে অভিনয় করেন। এই নাটকে একজন মাস্তানের ভূমিকায় অভিনয় করে সফল সালমান। অথচ যে সময়ে তিনি নাটকটি করেন অন্য কেউ হলে এরকম চরিত্রে অভিনয় করার সাহস করতেন না। একটু উনিশ-বিশ হলে যা তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলতে পারতো। কিন্তু নাটকটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ‘নয়ন’ সে বছর বাচচাস এর শ্রেষ্ঠ নাটকের পুরস্কার পেয়েছিলো। সালমান মূলত যেখানেই হাত দিয়েছিলেন সেখানেই সফল হয়েছিলেন।

সালমান পরবর্তী সময়ে অনেকেই সালমানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সালমান কেবলই সালমান। হয়তো আধুনিক বাংলা সিনেমার অন্যতম মায়েস্ত্রো। যার অকাল মৃত্যু এক ঘোর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিলা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতকে। অনেকদিন পর এসে অনেকেই চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সিনেমাকে তার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ততদিনে পানি গড়িয়ে গেছে অনেকদূর। একের পর এক হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।  এর  মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত দর্শকরা। মধ্যবিত্তের ঘুম বরাবরই রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো। সে ঘুম সহজে ভাঙে না। তবে সরওয়ার ফারুকী কিংবা তারেক মাসুদদের লড়াই বাংলাদেশের সিনেমাকে নতুন মোড় দিয়েছে। আবার অন্যদিকে শাকিব বা অনন্তরা সংকটকালীন সময়ে চলচ্চিত্রকেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্তের একটা নগন্য অংশ ইতোমধ্যে হলে ফিরতে শুরু করেছে। তবে আগের সেই ‘গণজোয়ার’ এখনো বহদূর। দিল্লি এখনো তাই দূর অস্তই বটে। তবে একদিন হয়তো দিন ফিরবে। যেদিন সকলে এক কাতারে হলের দিকে মুখ ফেরাবে। কিন্তু কে জানে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর না আসলে, আজ হয়তো সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকতে হতো না।

 

নতুন চোখে পথের পাঁচালী দেখা/রুহুল মাহফুজ জয়

১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট। কলকাতা ও শহরতলীর নয়টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল একটি ছবি।এ ছবির শুটিং শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। পথের পাঁচালী। বাংলা সিনেমা তো বটেই, যে ছবি মুক্তির পর বদলে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমার ভাষা। যে ছবি মুক্তির পর থেকেই পৃথিবীব্যাপী নবীন চলচ্চিত্র পরিচালকদের স্বপ্নের প্রেরণা।৭০ হাজার টাকা বাজেটের পথের পাঁচালী পা দিলো ষাট বছরে। আমেরিকা মুলুকে ফোরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছবিটার প্রিন্ট সংস্কার হয়েছে সম্প্রতি।

দূর্গা ও অপুর বাবা হরিহর চরিত্রে অভিনয় করা কানু ব্যানার্জি আর দু:সম্পর্কের পিসি ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রে অনবদ্য অভিনেত্রী চুনিবালা দেবীর জন্য বোড়াল গ্রামে যে মাটির বাড়ি আর উঠান ভাড়া নেয়া হয়, তার জন্য শুটিং ইউনিটকে মাসিক ভাড়া দিতে হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। চুনিবালা দেবীর রোজ পারিশ্রমিক ছিল ২০ টাকা। অপু চরিত্রের সুবীর বন্দোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি। শুটিং শেষে সুবীরের বাবার হাতে সত্যজিৎ রায় ২৫০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন।ছবি মক্তির পর এই মানুষগুলোই বিশ্ব চলচ্চিত্রের অমর মুখ।

পথের পাঁচালী নিয়ে লিখতে বসে আসলে ভাষাহীনতায় ভুগছি। অতিমুগ্ধতা আর অতিপ্রেম মনে হয় প্রেমিক-প্রেমিকা। পুরা লায়লা-মজনু টাইপ। এই দুইটা বিষয় মেটাফিজিক্যাল জগত থেকে মানুষকে একটা স্ট্যাটিক জগতের সামনে দাঁড় করায়ে দেয়। তা কিছুক্ষণের জন্য হলেও। আর পথের পাঁচালী সিনেমার দর্শককে এই অভিজ্ঞতা দিচ্ছে গত ষাট বছর ধরে। দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।

সম্প্রতি ছবিটা আবার দেখলাম। আবারও বাংলা সিনেমার ‘মাণিক’কে সিন ধরে ধরে প্রণাম দিলাম মনে মনে। পথের পাঁচালী যতবারই দেখি, কম করে হলেও নিজের শৈশবের নব্বই শতাংশ সিনামেটিক ইমেজে দেখতে পাই। নমস্কার সত্যজিৎ রায়…নমস্কার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।

পথের পাঁচালী ছবিটা শুরুর তৃতীয় দৃশ্যেই আমি নিজের শৈশবে ফিরে যাই। ছোট্ট দূর্গা বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে,তার ভেতর একটা লুকোচুরি ভাব—এই দৃশ্য থেকে যতবার ওই বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে দূর্গা আর অপু চলাচল করেছে (হোক দৌড়ে বা হেঁটে), ততবারই মনে হয়েছে ওরা আমার ছোটফুপি আর ছোটকাকা। দূর্গার মুখায়বে আমি মাঝেমাঝে পারু খালার মুখটাও বসায়ে দেই। সেই কৌতুহলী চোখে, সেই চঞ্চলতা, সেই ডুরে শাড়ি। অপু কখনও কখনও আমার ছোটকাকা, কখনও আমি নিজেই।

সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কাজ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মিউজিক পথের পাঁচালীকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। ছোট থেকে বড়, পথের পাঁচালী ছবির প্রতিটি চরিত্রের ডিটেল অসাধারণ। মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা মিঠাই বিক্রেতা বা পাঠশালার পণ্ডিত—স্ক্রিনে জায়গা পেয়েছেন দু’একবার। কিন্তু তাদের চরিত্র ভুলবার নয়। এমনকী ছবির কুকুর-বিড়ালগুলোও না।

দূর্গা, অপু আর সর্বজয়া— দুই ভাই-বোন ও তাদের মা পথের পাঁচালীর মূল চরিত্র। কখনও কখনও আমার কাছে মনে হয়েছে, এই তিনজনকে ছাপিয়ে গেছেন বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুণ। মনে হয় এই চরিত্রটাই পথের পাঁচালীর সবচে শক্তিশালী চরিত্র। এই ছবিতে অভিনয় করা কাউকেই মনে হয়নি অভিনয় করেছেন। কিন্তু চুনিবালা দেবীর জন্ম আর ৮৩ বছরের জীবনপ্রাপ্তি যেন পথের পাঁচালীর ‘ইন্দির ঠাকরুণ’ হবার জন্যই। ছবিটা যে বছর মুক্তি পায়, সে বছরই মারা যান চুনিবালা। বিশ্ব সিনেমার সৌভাগ্য,এমন একজন অভিনেত্রীকে সত্যজিৎ রায় খুঁজে বের করেছিলেন। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে পথের পাঁচালী যেমন আজও প্রিয়,তেমনি মৃত্যুর ৬০ বছর পরেও চুনিবালা দেবী বেঁচে আছেন। তবে চুনিবালা হিসাবে নন, ইন্দির ঠাকরুণ পরিচয়ে। এখানেই নির্মাতা সত্যজিৎ বা অভিনেত্রী চুনিবালার সার্থকতা। এ ছবিতে অভিনয় করা অনেকেই পরে আর পর্দায় আসেননি, কিন্তু তারা অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসাবে জগৎখ্যাত। তা পথের পাঁচালীর সৌজন্যে।

পথের পাঁচালীতে ধনী-নির্ধন, ক্ষুধা আর সুখের মধ্যবর্তী যে সংকট, তার পুরোধা বৃদ্ধা ইন্দির। তার গপগপ করে ভাত খাওয়া এবং সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট দূর্গার ঢেঁকুর তোলার যে দৃশ্য, তার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই ক্ষুধার সরলীকরণ। সংবেদনশীলতা। আশি বছর বয়সী একজন মানুষের জন্য ক্ষুধা যেরকম, সাত-আট বছর বয়সীর জন্যও ঠিক সেরকমই।

নুন আনতে পানতা ফুরানো হরিহর-সর্বজয়ার সংসারে দুই সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না ঠিকমতো। সেখানে ইন্দির এক প্রকার বোঝা। বৃদ্ধা তা বোঝেন এবং মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এখানে অসহায় ইন্দির ঠাকরুণের প্রতিবেশ-পরিস্থির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার যে সংগ্রাম, তা আশ্রয়হীন মানুষের চিরায়ত। ইন্দিরের হাঁটা-চলা, অসহায় তাকিয়ে থাকা যেন মৃত্যুমুখী মানবতার চিত্র।

দূর্গা-অপুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রাত্তিরে ইন্দির ঠাকরুণের গল্প বলার দৃশ্যটা একবার মনে করে দেখুন। কি চমৎকার সিনেমাটিক ইমেজের সৃষ্টি! তিনি রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলছেন। দেয়ালে ইন্দিরের মুখের অবয়বটা এমনভাবে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে যে, ওই ছায়াটাই যেন রাক্ষস! ছবিতে ইন্দির ঠাকরুণের কণ্ঠে একটা গান আছে, “যারা পরে এলো, আগে গেলো, আমি রইলাম পড়ে… ওরে দিন যে গেলো, সন্ধ্যে হলো, পাড় করো আমারে”। কোন বাংলা সিনেমায় চরিত্রের সঙ্গে গানের এমন যুক্তিযুক্ত ব্যবহার আর কি হয়েছে? মনে করতে পারছি না।

সর্বজয়া ইন্দির ঠাকরুণকে রাখতে চান না নিজেদের বাড়িতে। চলে গেলেই খুশি হন। দুবার তাড়িয়েও দিয়েছেন। আবার সম্মানহানির ভয়ে আশ্রয়ও দেন। সর্বজয়ার এই সাইকোলজিক্যাল টানাপোড়েন এক কথায় অসাধারণ। আমার মতে, পথের পাঁচালী ছবির বড় সম্পদ। আশ্রয়হীন ইন্দির শেষবার যখন বাপের ভিটায় ফিরে এলো, তার চোখে-মুখে ছিলো মৃত্যুছায়া। তাকে জলপান করিয়ে বিদায় দিলো সর্বজয়া। যে বারান্দায় শুয়ে ইন্দির ঘুমাতো, সেখান একটি কুকুর খেলছে। ওদিকে তাকিয়ে সদর দরজা পার হয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই দৃশ্যের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় হয়তো সেই বার্তাটিই দিয়েছেন— কুকুর-বিড়ালের আশ্রয় আছে, দু বেলা খাবার আছে, মানুষের কাছে তবু মানুষেরই ঠাঁই নেই। পুঁজিবাদী মানসিকতা শুধু যে বিত্তশালীদের মধ্যেই থাকে, তা না। নুন আনতে পানতা ফুরায় টাইপের পরিবারে ‘বিলং’ করা মানুষের মধ্যেও তা লুকিয়ে থাকে। এমনকী নারীদের মধ্যেও। সর্বজয়া আর ইন্দির ঠাকরুণের মধ্যে টানাপোড়েন তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।

ইন্দিরের মৃত্যুদৃশ্যটা করুণ। সেই মৃত্যুদৃশ্যের আগে বাঁশবাগানে বসে বৃদ্ধার ঠিকানাহীনতা বা আশ্রয়হীনতার রিক্ত চাহনি দর্শকের বুকে হাহাকার তৈরি করে; সর্বজয়ার প্রতি কিছুটা হলেও ঘৃণা। ইন্দির ঠাকরুণের করুণ মৃত্যুর জন্য হয়তো অনেক দর্শক সর্বজয়াকে ক্ষমাও করেনি। যদিও ইন্দিরের মৃত্যু ঢেকে গেছে দূর্গার মৃত্যুতে। বৃদ্ধা পিসির অসহায়ত্বকে ছাপিয়ে গেছে জ্বরের ঘোরে কিশোরী ভাইজির ছোট ভাইকে বলা, “এবার জ্বর ছাড়লে রেলগাড়ি দেখতে যাবো রে”। দূর্গার আরেকবার রেলগাড়ি দেখা হয় না। জ্বরে দূর্গার মৃত্যু, অসহায়ত্বে সর্বজয়ার কান্না দর্শক হৃদয়ে এক চিরহাহাকারের জন্ম দেয়। যে হাহাকারের স্রোতে ভেসে যায় ইন্দির ঠাকরুণের করুণ জীবন ও মৃত্যু। একটা নতুন বড় দু:খ, চারপাশের আর সব ছোট-বড় দু:খকে এভাবেই গ্রাস করে ফেলে সবসময়।

তারও আগে-পরে পুরো ছবি জুড়ে দর্শকরা দেখে দুই ভাই-বোনের দূরন্ত কৈশোর। বাঙালি দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোর যে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের চেয়ে অনেক বেশি দূরন্ত আর দু:সাহসিক হয়, পথের পাঁচালী যেন তারও ছায়াচিত্র। আমরা দেখি, মিঠাইওয়ালার পিছু পিছু ছুটছে অপু, দূর্গা আর তাদের কুকুর। লং শটে পথের পাশে পুকুরের পানিতে তাদের চলমান প্রতিবিম্ব। সে এক দৃশ্য বটে!

বাঁশবনে চড়ুইভাতিতে স্বাভাবিক কৈশোরের দুরন্তপনার পর আমরা দেখি, সমবয়সী সখীর বিয়ের আসরে দূর্গার চোখে জল। পয়সাওয়ালা পরিবারের মেয়ে হলে তারও যে এতদিনে বিয়ে হতো, সেই ভাবনাতেই হয়তো এই কষ্ট। যা সইতে না পেরে চোখের কোনে জল হয়ে ঝরে পড়েছে। নিজের বিয়ের জন্য দূর্গাকে খেলার ছলে শ্লোক পড়তেও দেখে দর্শক। ছবির বেশ কিছু দৃশ্যেই দূর্গা চরিত্রের মাধ্যমে যৌবনোন্মুখ সময়ে মেয়েদের অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আমার আট-দশ বছর বয়সে যখন আমাদের গাঁয়ে প্রথম বিদ্যুত এলো, মুরব্বীদের নিষেধ সত্বেও বিদ্যুতের খুঁটিতে কান পাততাম। ঝিম মারা একটা শব্দ আর কম্পন পাওয়া যেতো তাতে। সেই ঘটনা নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের। তখন থেকে চল্লিশ বছর আগেই যে এই দৃশ্য পথের পাঁচালীতে ধারণ হয়েছে, তা জানাই ছিলো না। কাশবন পেরিয়ে অপু-দূর্গার প্রথম ট্রেন দেখার মুহূর্তটা বিশ্ব সিনেমার কালজয়ী একটা মুহূর্ত বা দৃশ্য হয়ে আছে। ট্রেন দেখাটাও যে একটা বড় মোহ, বাঙালির ছোটবেলার চেয়ে তা কে আর ভালো জানে!দূর্গা-অপুর বৃষ্টিতে ভেজার মতো দৃশ্যকাব্য আর কটা ছবিতে আছে, এতটা আবেদন নিয়ে! যদিও সেই বৃষ্টি বিরাট এক ট্র্যাজেডির কারণ।

পথের পাঁচালীর শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি,স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কাশী চলে যাচ্ছেন হরিহর; জীবনের বাঁক বদলের আশায়। এই যাত্রা আসলে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশে গ্রামীণ জীবন থেকে শহুরে জীবনে প্রবেশযাত্রা। যে যাত্রার বিকাশ স্পষ্টত ‘অপরাজিত’ হয়ে ‘অপুর সংসার’ ছবিতে গিয়ে থেমেছে। গ্রামের একটা সাধারণ পরিবারের ছেলে ‘অপু’ কিভাবে আধুনিক, শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, তা জানতে হলে দর্শককে ‘অপু ট্রিলজি’ দেখতে হবে। যার শুরুটা ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে।

দুনিয়ার হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি থেকে একদম সাধারণ দর্শক, সবার কাছে ‘পথের পাঁচালী’ কেন প্রিয় সিনেমা হয়ে উঠলো? তা ভাবতে গিয়ে যে উত্তর পেলাম, তা এরকম— সেলুলয়েডে সত্যজিৎ রায়ের গল্প বলার সততা, অর্থাৎ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা আর পরিচালক সত্যজিৎ’র সিনেমাটিক ইমেজের রসায়নটা এমন খাপে খাপ হয়েছে যে, পথের পাঁচালী হয়ে উঠেছে ‘বাঙালিত্ব’ আর বাঙলা জনপদের সত্যিকারের ছবি। যা হাজার বছরের। অপু-দূর্গা পথের পাঁচালী সৃষ্টির আগেও ছিলো, বিভূতির সময়ে ছিলো, সত্যজিৎ’র সময়ে ছিল, আছে এখনও।

দরিদ্রতা যে সকল বাঙালির ঘরে ছিল বা আছে, পথের পাঁচালীর অপু-দূর্গা আর তার পরিবারের ছবিটা সেখানে চিরকালীন। কিশোরী দূর্গার মানসিক টানাপোড়েন, আনন্দ-বিষাদ গাঁয়ের কোন বাঙালি কিশোরীর নেই? প্রাচ্য, পাশ্চাত্য বা ল্যাটিন, সকল সমাজেই তো কৈশোরের দূরন্তপনা একই রকম হবার কথা। আর্থ-সামাজিক যে বক্তব্য পথের পাঁচালীতে তুলে ধরা হয়েছে, তা যেমন আমেরিকাতে আছে; আছে সুদান, নিকারাগুয়া বা আর্হেন্তিনাতেও। সারা পৃথিবী জুড়েই আসলে কৈশোর আর দারিদ্রের ভাষা এক। পথের পাঁচালী তাই একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে দুঁদে, সবারই ছবি।পথের পাঁচালী বুঝলে আসলে বাঙালির মন বোঝা যায়, যা আবহমান।

 

আহা!, আক্ষেপ ও বিস্ময়মাখা এক দীর্ঘশ্বাস/ মোহাম্মদ ফয়সাল

AHA ! Poster Lowবলাই বাহুল্য যে একটি চলচ্চিত্র প্রথমত ও প্রধানত এর নির্মাতাকে প্রতিনিধিত্ব করে; নির্মাতার দর্শণ, সৃজনশীলতা, বিশ্বাস, মনস্তত্ত্ব, রুচিবোধ, অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয় চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি অনুষঙ্গে। এই সূত্র অনুসরণ করে শুধু ‘আহা!’ দেখে কোনও অনুসন্ধিৎসু দর্শক যদি এর পরিচালক সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি বেশ কিছু দিক খুঁজে পেতে পারেন। সেগুলো নিয়েই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

১.

স্থাপত্যশিল্পের প্রতি পরিচালকের নিদারুণ অনুরক্তি খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্রই হচ্ছে একটি ক্ষীয়মান পুরানো দালান। যা ভেঙ্গে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের পায়তাড়া চলছে। এছাড়া পরিচালক প্রাসঙ্গিকভাবেই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অংশে ঢাকার বিশেষ কিছু স্থাপত্যকীর্তি প্রদর্শন করেছেন। যেমনঃ রুবা (সাথী ইয়াসমীন) যখন বাংলাদেশে এসে বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ক্যাব করে নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তখন তার Point of View (POV) থেকে নভোথিয়েটার, জাতীয় সংসদ ভবন দেখানো হয়। আবার রুবা যখন কিসলুর (হুমায়ুন ফরিদী) সঙ্গে দেখা করে তখন তাদেরকে লালবাগের কেল্লায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পরিচালক বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশিল্প উপস্থাপন করেছেন এই চলচ্চিত্রে।

২.

পরিচালক ভীষণ রকম গোছানো, ফোকাসড, মিনিমালিস্ট। বিশাল ক্যানভাসে বিক্ষিপ্ত অজস্র ঘটনার সম্মিলন না ঘটিয়ে খুব সীমিত কলেবরে, অল্প সংখ্যক চরিত্রের মাধ্যমে ‘আহা!’র গল্প বলেছেন। এটা করতে গিয়ে আবার কোনরকম একঘেয়েমি তৈরী হয় নি। বরং ১২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই দর্শকের মনোযোগ ও আগ্রহ অটুটভাবে ধরে রাখতে সক্ষম। পরিচালক আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা একটা গল্প বা বিষয়বস্তু নির্বাচন করে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবার জন্য প্রতিটি বিভাগের ব্যপ্তি সীমিত রাখবার চেষ্টা করেছেন। উদাহারণস্বরুপ উল্লেখ করা যায় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত লোকেশনের প্রসঙ্গ। এই চলচ্চিত্রটির সিংহভাগ দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে শুধুমাত্র মল্লিক সাহেবের (তারিক আনাম) বাড়িতে; এই বাড়ির বারান্দা, বিভিন্ন ঘর আর উঠানেই চলচ্চিত্রটির প্রায় ৮০ শতাংশ দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। মূলতঃ স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুপরিকল্পিতভাবে দৃশ্যধারণ করবার জন্যই এ চলচ্চিত্রে অল্প সংখ্যক লোকেশন ব্যবহার করা হয়েছে।

আহা! সিনেমার কিসলু চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি

আহা! সিনেমার কিসলু চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি

৩.

সংগীতের প্রতি পরিচালকের অনুরক্তিও এই চলচ্চিত্রে লক্ষ্যণীয়। ‘আহা’র সংগীতায়োজন করেছেন দ্যেবজ্যেতি মিশ্র, যিনি এই চলচ্চিত্রের জন্য ৬টি মৌলিক গান সুর করেছেন এবং প্রতিটি গানের কথা লিখেছেন পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর নিজেই। গতানুগতিক অন্যান্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মত গানগুলোতে অভিনয়শিল্পীদের ঠোট মেলাতে (Lip Sync) বা নাচতে দেখা যায় না, বরং গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গানগুলোকে বিভিন্ন অংশে নেপথ্য সংগীত হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রগুলোর বিষাদ ও বিষন্নতা এই গানগুলোতেও সার্থকভাবে অনুরণিত হয়েছে যা এই চলচ্চিত্রের মূলভাবকে আরো পরিণত ও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে।

‘আহা!’ এক অর্থে কিছু নিঃসঙ্গ মানুষের একাকীত্বের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টার গল্প। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নির্বান্ধব, যারা নানাভাবে নিজেদের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর রুবা বাংলাদেশে এসে একাকী জীবন কাটাতে শুরু করে, তার কোন পুরানো বন্ধুবান্ধবকেও এখানে দেখা যায় না। এক পর্যায়ে পাশের বাড়ীর কিসলু নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে তার সখ্যতা তৈরী হয়, যিনি নিজেও একটি ফ্ল্যাটে একাকী জীবনযাপন করেন। রুবার বাবা মল্লিক সাহেব বিপত্নীক হয়েছেন বহু আগে ( কথাপ্রসঙ্গে জানা যায় রুবাকে মেট্রিক পরীক্ষার পর তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয় কারণ মা-মরা মেয়েকে দেখাশোনা করবার কেউ ছিল না), যাকে মধ্যরাতে স্ত্রীর পুরানো ঘরে মন খারাপ করে একলা বসে থাকতে দেখা যায়। রুবার মিনা খালারও (প্রজ্ঞা লাবণী) স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক আগে, যিনি রুবাকে নিয়ে এক বিকেলে ছাদে হেটে বেড়াবার সময় তার পোষা কবুতরগুলো দেখিয়ে বলেন “ওরাই তো আমার সংসার। আমার ছেলেমেয়ে, ওরাই তো সব!”

একটি দৃশ্যে কিসলুর বন্ধু খাদেমকে (খালেদ খান) বলতে শোনা যায় “আমি শেয়ার বাজার করি বলে কি কবিতা লিখতে পারব না? আরে যার চরিত্রে যত বেশী contrast, তার চরিত্রই তো তত বেশী interesting!” ‘আহা!’র প্রতিটি চরিত্রেই ভীষণ রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। খাদেম তার বন্ধুকে ‘ভেঁদামাছ’ বলে গালি দিলেও কিন্তু কিসলুকে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবসময় পরিপাটি করে আচড়ানো চুল এবং ভারী চশমা আর সাদামাটা পোশাক পড়া কিসলুকে দেখে খুব শান্ত, নিরীহ, গোবেচারা ধরণের মানুষ মনে হলেও, তাকে একসময় হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে দেখা যায়। সে যখন রুবাকে নিয়ে বুড়ীগঙ্গা সেতুতে ঘুরতে যায় তখন নদীর নোংড়া, দূষিত পানি দেখে চিৎকার করে বলে “ওই মানুষ! তোরা এত অসভ্য কেন? নিজেরা যেই নদীটাকে ব্যবহার করিস আবার সেই পানিই নষ্ট করে ফেলেছিস! তোদের লজ্জা করে না?” আবার কিসলুকে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রঙের আন্ডারগার্মেন্টস নিজের বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখা গেলেও তাকে সবসময় সাদা পাঞ্জাবী আর প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখা যায়। পোশাকের এরকম পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালক মূলতঃ কিসলু চরিত্রের বোকাটে বেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রগাড় প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বকেই ইঙ্গিত করেছেন।

আহা! সিনেমার একটি দৃশ্যে সাথি ইয়াসমিন ও হুমায়ূন ফরীদি

আহা! সিনেমার একটি দৃশ্যে সাথি ইয়াসমিন ও হুমায়ূন ফরীদি

এরকম ‘স্ববিরোধতা’ অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝেও দৃশ্যমান। যেমন মল্লিক সাহেবকে এখানে একজন নীতিবান, পরহেজগার মানুষ হিসাবে দেখানো হয়, আবার এই মল্লিক সাহেবই সোলেমান নামের এক স্বঘোষিত খুনীকে নিজের বাড়ীর দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ দেন, এমনকি চলচ্চিত্রের শেষ অংশে কিসলুকে হত্যা করবার নির্দেশও দেন যা তার মহনীয় ব্যক্তিত্বের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। আবার এই সোলেমানকে ক্রিকেট খেলার ভীষণ ভক্ত হিসাবে দেখা যায়, বাড়ীর কাজের ছেলে রতনের সাথে দেখা হলেই সে তাকে বাংলাদশের খেলার স্কোর জিজ্ঞাসা করে। রতন একসময় বিরক্ত হয়ে বলে ‘প্রতিদিনই কি বাংলাদেশের খেলা থাকে?’ কিন্তু এই সোলেমানই আবার পাড়ার ছেলেদের বাড়ীর সামনে ক্রিকেট খেলা মোটেও পছন্দ করে না এবং একবার ক্রিকেটের বল নিতে একটি ছেলে বাড়ীতে ঢুকলে তাকে বেধড়ক পেটায়। এরকমভাবে প্রতিটি চরিত্রের আচরণে নানারকম অসঙ্গতি দেখা যায় যা প্রকৃতঅর্থেই চরিত্রগুলোকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে।

শুধু চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বই নয়, বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে ব্যক্তিত্বের সংঘাতও এই চলচ্চিত্রে বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহারণস্বরুপ আসিফ (ফেরদৌস) ও কিসলু চরিত্র দু’টির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আসিফ একদিকে বেশ কেতাদুরস্ত, চঞ্চল, আধুনিক আর কিসলু কিছুটা রাশভারী, সাদাসিধা ও সেকেলে। তারা যখন রুবার ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে মিলিত হয় তখন তাদের নিজেদের পরিচয় দেবার পর্বটি বেশ কৌতুকাবহ। আসিফ নিজের সম্পর্কে বলে “আমি business করছি… মানে চেষ্টা করছি, Trying to do something.”, প্রত্যুত্তরে অপরজন বলে “আমি কিসলু, কিসলু হাসান, কিছু না করার চেষ্টা করছি।”

এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রের কথা বলার ধরণের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন রফিক সাহেব (শহিদুল আলম সাচ্চু) চাপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা এবং স্বভাবতই তার কথায় রাজশাহীর টান লক্ষ্য করা যায়। মল্লিক সাহেবের পাড়ার ছেলেরা পুরান ঢাকাবাসীর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে কথা বলে, আবার রুনা খালা কথা বলেন পুরোপুরি প্রমিত বাংলায়। আসিফ আর রুবাকে প্রচুর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের কথা বলার ধরণ একটু খটকা তৈরী করে কারণ তিনি পুরান ঢাকাতে জন্মগ্রহণ করেছেন ও প্রতিপালিত হয়েছেন কিন্তু কথা বলা বলেন শুদ্ধ বাংলায়।

মল্লিক সাহেবের ভঙ্গুরপ্রায় বাড়ীর জায়গায় নতুন দালান বানাবার প্রলোভন দেখাচ্ছে ‘Dream Properties’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান আর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসাবে দেখা যায় রফিক নামের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে যার উপস্থিতি যথাসম্ভব অপ্রীতিকরভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। গাড়ো কালো বর্ণের বেঢপ আকৃতির রফিক সাহেবকে ধূসর বর্ণের পোশাক, সোনালী ফ্রেমের চশমায় বেশ বিচিত্র লাগে, আর কথা বলার সময় অশালীন শব্দের ব্যবহার, অপরিশীলিত কার্যকলাপের মাধ্যমে (যেমনঃ কাপে ঢেলে শব্দ করে চুমুক দিয়ে চা খাওয়া, তোতলামি করা, বাতকর্ম করা) তাকে আরো বিরক্তিকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলতঃ মুনাফালোভী রিয়েল এস্টেট ডেভলপারদের অশুভ তৎপরতার প্রতি পরিচালকের বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে রফিক চরিত্রের মাধ্যমে। রফিক সাহেব সময়ে-অসময়ে মল্লিক সাহেবকে এসে বাড়ী ভাঙ্গার দলিলে স্বাক্ষর করবার জন্য তাগাদা দিয়ে বিরক্ত করেন, কিন্তু স্থাপত্যবিদ্যার কিছু শিক্ষার্থী যখন বাড়ীটির ছবি তুলবার জন্য ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চায়, তখন সোলেমান তাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেয় না। বর্তমান সমাজে ধূর্ত স্বার্থানেষী মানুষেরা যে খুব সহজেই নিজেদের সুযোগ তৈরী করে নেয় আর মননশীল লোকেরা নির্বিঘ্নে তাদের সুকুমার বৃত্তির পরিচর্যা করতে পারে না ,এই ঘটনা মাধ্যমে সেই বৈষম্যের দিকেই পরিচালক ইঙ্গিত করেছেন।

‘আহা!’ চলচ্চিত্রের অন্যতম রহস্যময়, জটিল ও মানসিকভাবে উপদ্রুত চরিত্র হচ্ছে সোলেমান এবং এই চরিত্রকে নিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালক কিছু মজার পন্থা অবলম্বন করেছেন। যেমনঃ সোলেমান উপস্থিতি রয়েছে এমন কিছু দৃশ্যের নেপথ্যে মাছির ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শোনা যায় যা এক ধরণের অস্বস্তি তৈরী করে। সোলেমানের স্বপ্নদৃশ্যে কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য (যেমনঃ হাতির ক্লোজ-আপ শট, বাংলা ছবির নায়িকার চেহারা) প্রদর্শন করে তার ভীতি, অবদমিত কামনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। পাড়ার ছেলদের সাথে আগ বাড়িয়ে বিবাদে জড়ানো, বুবার (রুবার ছেলে) খৎনার অনুষ্ঠানে আয়োজিত মুরগি লড়াইয়ের সময় তার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়া, বাড়ীর ছবি তুলতে আসা ছেলেদের সাথে অনর্থক দুর্ব্যবহার করা ইত্যাদি তার হিংস্রস্বত্তারই পরিচয় বহন করে।

চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত রুবার অবদমিত কামনাকেও পরিচালক একটি রূপক দৃশ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এই দৃশ্যটিতে কোন সংলাপ নেই, শুধু নেপথ্যে দ্রুত লয়ের একটি সংগীত শোনা যায়, যেখানে সমস্বরে কিছু পুরুষ বারংবার ‘আহা’ বলতে থাকে। এ দৃশ্যে ভারী বৃষ্টির মাঝে একদল ছেলেকে খালি গায়ে রুবাদের বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তারা মাঠে একটি ফুটবল নিয়ে খেলা শুরু করে, কিন্তু খেলায় কোনরকম শৃঙ্খলা দেখা যায় না। সবাইকে ফুটবলের দখল পেতে মরিয়া দেখা যায়। রুবা ছেলেগুলোকে খেলতে দেখে অবাক হয় না, বরং বাড়ি থেকে বের হয় আসে। বৃষ্টির মধ্যেই তাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায়, যেন সে ছেলেগুলোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে রুবা এবং খেলায় মগ্ন ছেলেগুলোকে কখনো এক ফ্রেমে দেখা যায় না। এ দৃশ্যের শেষ শটে দেখা যায়, রুবা চোখ বুঝে বৃষ্টির মাঝে ওপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ক্যামেরা তাকে ঘিরে ঘুরছে। হঠাৎ ঢাকের বাড়ির মধ্য দিয়ে নেপথ্য সংগীত শেষ হয়, আর রুবা চোখ মেলে ক্যামেরার দিকে তাকায়, যেন এ আওয়াজে সে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্য ও ক্লোজ-মিড-লং শটের সমন্বয়,অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের বিপরীতে রুবার হলুদ শাড়ি, হল্লারত ছেলেদের ফুটবল নিয়ে কাড়াকাড়ি, দ্রুত লয়ের সংগীত সব মিলিয়ে এ দৃশ্যটির মাধ্যমে নিপুনতার সঙ্গে পরিচালক রুবার শমিত বাসনাকে উপস্থাপন করেছেন।

যে গুটিকয়েক বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী তার মধ্যে অন্যতম ‘আহা!’। রুবা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অসহায়ত্ব পরিচালক সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রুবার বিয়ে হয়ে যায় বেশ অল্প বয়সেই, ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করেই এক প্রবাসী ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয় এবং সহজেই বোধগম্য যে বিয়েতে তার মতামত খুব একটা গুরুত্ব পায় নি। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলে বুবাকে নিয়ে রুবা দেশে ফিরে আসে, আশ্রয় নেয় বাবার ঘরে কিন্তু এখানেও সে নানাভাবে নিগৃহীত হতে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে বাবার মতামতের কাছে তাকে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করতে হয়। বুবার মুসলমানীর অনুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণভাবে করতে রাজী না থাকলেও বাবার গোয়ার্তুমির কাছে সে হার স্বীকার করে, বারংবার বাবাকে বাড়ী ভাঙ্গার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়, সোলেমানকে বিদায় করবার জন্য অনুরোধ করেও বাবাকে রাজী করাতে পারে না। রুবাকে অনেকবারই জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যা তার বন্দী দশাকেই রুপকঅর্থে ফুটিয়ে তোলে। মার্জিত, শিক্ষিত খালাতো ভাই আসিফও যখন অন্যায়ভাবে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করে তখন সে তার প্রতিবাদ করলেও রাতের আধারে তাকে অঝরে কাঁদতে দেখা যায়। একমাত্র কিসলুর সঙ্গেই তার একরকম সখ্যতা তৈরী হয়, কিন্তু এখানেও তার বাবা বাধা হয়ে দাড়ান। বাবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে রুবা তাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখার কথা বললে মল্লিক সাহেব কিসলুকে খুন করবার সিদ্ধান্ত নেন। তার মৃত্যুসংবাদ শুনে একবার কিসলুর বাড়ীতে যেতে চাইলেও বাবা তাকে টেনেহেচড়ে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলেন। এভাবে রুবাকে পদে পদে পরাজিত হতে দেখি। অপরদিকে মল্লিক সাহেব অনায়াসেই তার পুরানো দালান ভাঙ্গার অনুমতি দিলেও তার পুরাতন সংস্কারবোধে তিনি কোনরকম আচড় পড়তে দেন না।

সম্পাদনা সম্পর্কে আন্দ্রে তারকাভোস্কি বলেছিলেন যে হলিউডের কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে সেগুলোর সম্পাদনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যাবে এই চলচ্চিত্রগুলোর সম্পাদনা একই ব্যক্তি করেছেন। কিন্তু বার্গম্যান, ব্রেসো, কুরোশোয়া, এন্তোনিয়নিদের মত মেধাবী পরিচালকদের সম্পাদনার কৌশল বা স্টাইল একেকরকম, তাদের প্রত্যেকের সম্পাদনায় স্বকীয়তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে (পৃ-১২১, স্কাল্পটিং ইন টাইম)। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রেও পরিচালক নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আহা’র সম্পাদনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রচুর Cross-cutting (একই সময়ে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা সমান্তরালভাবে দেখানো) এর ব্যবহার যা সচরাচর কোন চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। সাধারণত উদ্বেগ (suspense) তৈরী করবার জন্য Cross-cutting এর ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এই চলচ্চিত্রে এর ব্যবহার করার পেছনে কারণ হিসাবে ধারণা করা যায় চলচ্চিত্রের ঘটনাপ্রবাহে কিছুটা গতি সঞ্চার করা। চলচ্চিত্রের শটগুলোর দৈর্ঘ্য প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছুটা দীর্ঘতর যা চলচ্চিত্রের আবহকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে, কিছু কিছু দৃশ্য একটিমাত্র শটেই ধারণ করা হয়েছে, যেমন পাড়ার ছেলেদের দ্বারা সোলেমানের প্রহৃত হবার দৃশ্য, পাশা ভাইয়ের সাথে পাড়ার ছেলেদের কথোপকথন ইত্যাদি যা পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে।

‘আহা!’ তে প্রচুর High Angle ও Low Angle Shot ব্যবহার করা হয়েছে, যার অনেকগুলোতেই পরিচালক চাইলেই ক্যামেরা Eye Level এ রাখতে পারতেন। নির্মাতা ইচ্ছা করেই এই ব্যতিক্রমী পন্থা অবলম্বন করেছেন যা দর্শককে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে কৌতুহলী ও মনোযোগী রাখতে সমর্থ হয়েছে। যেহেতু চলচ্চিত্রের বেশীর ভাগ অংশের চিত্রধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধ জায়গায় তাই যথোপযুক্তভাবেই এই চলচ্চিত্রে মিড শট ও ক্লোজ শটের প্রাধান্য খুব বেশী যা দর্শকের মনে একধরণের আবদ্ধ বা Claustrophobic অনুভূতি তৈরী করে। এই চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক Long Shot ব্যবহার করা হয়েছে রুবা ও কিসলুর ঘুরে বেড়ানো দৃশ্যে যেখানে তাদের লালাবাগের কেল্লা, বুড়ীগঙ্গার ব্রীজ প্রভৃতি জায়গায় গল্প করে বেড়াতে দেখা যায়। এই দৃশ্যগুলোতে Long Shot এর ব্যবহার করে শুধু সাময়িকভাবে রুবার মুক্ত হবার আনব্দকেই নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলে না এটা দর্শককেও একরকম Breathing Space দেয়।

‘আহা’ চলচ্চিত্রে অনেকজন প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীর সমাগম হয়েছে যাদের অসামান্য অভিনয় এই চলচ্চিত্রটিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। তারেক আনাম খান, হুমায়ুন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু প্রত্যেকেই নিপুনভাবে নিজেদের চরিত্র রুপায়ন করেছেন যা চলচ্চিত্রটির প্রতি তাদের মমতা ও দায়বদ্ধতারই (commitment) পরিচয় বহন করে। বেশীর ভাগ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ ৩/৪ টি চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু অন্যান্য শিল্পীদের দুর্বল অভিনয়ের কারণে অনেক সময় চলচ্চিত্রগুলো ন্যূনতম মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রটি এই দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। এখানে প্রতিটি চরিত্রকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট চরিত্রেগুলোতে শহীদুল আলম সাচ্চু,গাজী রাকায়েত,প্রজ্ঞা লাবনীর মত কুশীলবদের প্রাণবন্ত ও সাবলীল অভিনয় চলচ্চিত্রটিকে বাস্তবিক করে তুলেছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়বে কিসলুর বন্ধুর চরিত্র রুপদানকারী খালেদ খানের অনবদ্য অভিনয়। তার বাচনভঙ্গী, একটু পরপর বিচিত্রভাবে হাত ঝাঁকি দেয়া, চপল (Prankinsh) চাহনি ও কৌতুকময় সংলাপ বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে যা তার খুব সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিকেও তাৎপর্যময় করে তুলেছে।

এই চলচ্চিত্রের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছে সাথী ইয়াসমীন যে কি-না এই চলচ্চিত্রের অন্যান্য শিল্পীদের তুলনায় কিছুটা কম পরিচিত। ‘আহা!’র কলাকুশলীদের এক টেলিভিশন আলাপচারিতায় পরিচালক নির্ঝর কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন যে এ চরিত্রটির করবার জন্য তিনি অনেককেই প্রস্তাব দিয়েছেন যারা কেউই সাড়া না দেয়ায় তিনি কিছুটা হতাশও হয়ে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হুমায়ুন ফরিদী এই প্রসঙ্গে বলেন যে সাধারণত জনপ্রিয় নায়িকারা কোন বাচ্চার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চায় না কারণ তারা মনে করে যে এতে দর্শকদের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা কমে যায়। যেখানে সমসাময়িক অন্যান্য কলাকুশলীদের মাঝে এমন উদ্ভট ও অপেশাদারী মনোভাব কাজ করে, সেখানে পরম মমতায় রুবা চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলবার জন্য সাথী ইয়াসমীন আন্তরিক সাধুবাদের দাবিদার।

ইদানীং খুব হেলাফেলায় চলচ্চিত্র নির্মান করে পরিচালকদের তা নিয়ে অহেতুক বড়াই করতে দেখা যায়, কিন্তু একটি চলচ্চিত্রের সবধরণের দুর্বলতা উপেক্ষা বা ক্ষমা করা গেলেও যা ক্ষমার অযোগ্য তা হচ্ছে চলচ্চিত্রটির প্রতি পরিচালকের উদাসীনতা।কেউ যদি শুধুমাত্র এ ব্যাপারটি মাথায় রেখে ‘আহা!’কে মূল্যায়ন করতে চায় তাহলে হয়ত সে একতরফাভাবে এর ভূয়সী প্রশংসা করে গেলেও অপরাধ করবে না কারণ চলচ্চিত্রটির প্রতিটি বিভাগে নির্মাতার যত্ন,চিন্তা ও পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। এনামুল করিম নির্ঝর সরকারী অনুদানে এরপর আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মান করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা এখনো মুক্তি দিতে পারেন নি। ‘আহা!’ নির্মানের পর গত ৬ বছরে এই পরিচালকের আর কোন নতুন কাজ দেখবার সুযোগ হয় নি! এটা চিন্তা করলে, পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্রটি দেখে বনে যাওয়া ভক্তরা হয়ত নিজের অজান্তেই অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ উচ্চারণ করবেন- ‘আহা!’

সীমানা পেরিয়ে অন্য সীমানায়/শাহাদাত হোসেন

শিল্পীকে অন্য আর দশটা মানুষের চাইতে বেশী তার সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। সমাজের ছোট-বড় সঙ্গতি-অসঙ্গতিকে শিল্পী যেভাবে ধারন করেন সেটা বোধকরি আর কেউ পারে না। তা শিল্পী কিভাবে তৈরী হন বা কোন পথে গেলে শিল্পী হওয়া যায়? প্রকৃত অর্থে তার কোনও শর্টকাট রাস্তা নেই। সুইডিশ কবি মারিয়া ওয়াইন বলছেন ‘That one sleeps in one’s childhood shoe’ মানুষের শৈশব তার পরবর্তী জীবনজুড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শৈশবের ছায়া তার কাজে, কর্মে, মননে জিজ্ঞাসার মধ্যে থাকে। তবু প্রত্যেকেরই কত আলাদা শৈশব, কৈশোর বেড়ে ওঠা।

আমার এই ছবির গল্পের সুত্রপাত আমার শৈশবের মধ্যেই। আসলে হিজড়া কি বা কারা হিজড়া এটা বুঝিনা তখনো। সেই প্রি-কর্পোরেট যুগে খুব সম্ভবত ১৯৮৯-৯০ সালের কথা। পাড়ার মাঠে আমরা সবাই ফুটবল খেলছিলাম। শীতের সময় দিনের বেলাটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। আসরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে চলে যেতাম খেলার জন্য। তা সেদিনও যথারীতি মাঠেই খেলছি। হঠাৎ খেলা চলার সময় বেশ শব্দে ঢোল আর তালির শব্দ কানে আসল। এরই মধ্যে আমার খেলার সঙ্গীদের কেউ একজন ‘ওই হিজলা আইছে’ বলেই ভো দৌড়। বাকিরাও অনেকটা বুঝে না বুঝে দিলো দৌড়। আমিও সেই দলে ছিলাম। তা দৌড়ে পাশের বস্তির মধ্যে একটা উঠানের মত খোলা জায়গায় দেখি একদল অদ্ভুত দর্শন মানুষ শাড়ি, ব্লাউজ পরে ঠোটে লিপস্টিক লাগিয়ে একটা বাচ্চাকে হাতের তালুতে দুলাচ্ছে আর গান গাইছে। সঙ্গের অন্যরা সেখানে কোরাসে গাইছে আর কান ফাটানো শব্দে হাত তালি দিচ্ছে। যেন সার্কাস দেখছি আর অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি। ওদেরকে মনে হচ্ছিল জাদুকর। আমার কিশোর চোখে সে ছবি এখনো আটকে আছে। ওরা নাচছে গাইছে, হাত তালি দিচ্ছে আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। আমার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছেনা, অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। কোনভাবেই আমার চোখের পলক পড়ছে না। হঠাৎ করে বাজপাখির ক্ষীপ্রতায় এক হিজড়া এসে আমাকে এসে জাপটে ধরল। সে আমাকে এতটা জোরে জাপটে ধরে যে তার প্যাডেড ব্রা’র স্ফীতাংশ চিমশে গিয়ে পাথরের মত বুকের কাঠিন্য আমি বুঝেছিলাম। সে বেশ অনেকক্ষণ আমাকে জাপটে থাকল। এতক্ষণ আমার প্রেমিকা ছাড়া আর আমাকে জাপটে থাকেনি কখনো। আমার দম আটকে আসছিল বোটকা ঘাম আর পেশীবহুল শরীরের চাপে। আমি চোখেমুখে কিছুই দেখছিলাম না। আমি জানিনা কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলাম। তবে ৫০ সেকেন্ড ছিলাম। আমার ধারনা যদিও তখন মনে হচ্ছিল ৫০ দিন আমি তার বুকের মধ্যে আটকে ছিলাম। যেহেতু পালাবার কোনও পথ নাই। সে হঠাৎ আমাকে তার বুকের পাশ থেকে অবমুক্ত করে আমার কাধে হাত রেখে বলল ‘কি রে কি দেখলি ঢাকা না দিল্লী?’ আমি ঘোরের মধ্যেই উত্তর দিলাম দিল্লী। এই একটি কথা আমার কানে এখনো বাজে। আর এই একটি প্রশ্নের উত্তর আমি আমার গোটা শৈশব কৈশোরে খুঁজেছি। কখনো কিছুটা মিলেছে, কখনো প্রশ্নটাই ধোয়াশা হয়ে উঠেছে নিজের কাছে। সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজছি এখনো। আমার নিজের মধ্যে জেগে থাকা এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার ছবিতে দেয়ার চেষ্টা করছি।

এই ছবি যদি কোনকিছু করতে পারে তবে সেটা হবে আমার উত্তরটা যদি মিলে যায় কোনভাবে? আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি, ঢাকায়, নারায়ণগঞ্জে, কলকাতায়, দিল্লীতে। ভিন্ন সীমান্তের অভিন্ন এই মানুষেরাই আমার ছবির প্রাণ। তাদের না বলা গল্প তারা আমাদেরকে বলেছে। আর তাদের না জানা গল্পগুলো আমরা শুনেছি। যা হয়ত প্রতিদিন বসে বসে অনেক আলাপের ভেতর থেকে জানা। আর একসঙ্গে থাকার যে কমিউনিটি লিভিং আমরা দেখেছি, হিপ্পি জেনারেশনের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তার একটা সেন্স আমি পেয়েছি এদের সঙ্গে মিশে। আমার ছবির এইসব মানুষেরাও জীবনের প্রয়োজনে অনেকে এক হয়ে থাকেন। ছোট্ট একটা ঘরে গুরু, নানগুরু, সহকর্মী, প্রেমিক আবার কখনো পালিত শিশুসহ ওরা একসঙ্গেই থাকে। আমরা এইসব মানুষের স্বপ্ন আর লড়াইয়ের গল্পটাই সিনেমার ভাষায় তুলে আনতে চাইছি। ঢাকার গোড়ানে ৯ ভাইবোনের সংসারে একজন কথার জন্ম হয়ে। আসলে কি সে এমন মনোজগত নিয়ে জন্মেছিল নাকি তার পরিপার্শ্বের গলি-ঘুপচি ঘুরে তার আদমের জীবন চাইতে ইচ্ছে করেনি। নাকি সে শুধু বৃহন্নলার জীবন নিয়ে মানুষের কাতারে দাঁড়াতে চেয়েছে? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজেছি বা নিরন্তর খুঁজেই বেড়াচ্ছি।

‘মেঘমল্লার’ ছবির প্রথম ট্রেইলার

মেঘমল্লার

 

 

অভিনয়েঃ শহীদুজ্জমান সেলিম, অপর্ণা, জয়ন্ত চট্রোপাধ্যায়, অদিতি,মারজান হোসাইন জারা

কারিগরি তথ্যঃ 

চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ জাহিদুর রহিম অঞ্জন

চিত্রগ্রহনঃ সুধীর পালসানে

সম্পাদনাঃ সামীর আহমেদ ও জুনায়েদ হালিম

সঙ্গীতঃ সুব্রত বসু

শব্দ পরিকল্পনাঃ রতন পাল

শব্দ মিশ্রনঃ অলোক দে

গ্রাফিক্সঃ পেপার বোর্ড ডিজাইন স্টুডিও, মুম্বাই

ডিসিপিঃ সিনেভেটর, মুম্বাই

 

প্রযোজনা ও পরিবেশনাঃ বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড

আমি ছবিটা বানাই নাই, ছবিটাই আমাকে দিয়ে বানাইয়া নিছে- কামার আহমেদ সাইমন

01

প্রশ্ন : বাইরের দেশে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, রাজনৈতিক সহিংসতার মতো ঘটনার কারণেই বেশী পরিচিতসেখানে আপনার কেন মনে হলো একটা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের সংগ্রামই আপনার ছবির প্রধান বিষয় হতে পারে? আপনার কি কখনো মনে হয় নি যে এই ছবিটা বাইরের দেশের দর্শকদের কাছে একটা বাজে ধারণা দিতে পারে?

কামার আহমেদ সাইমন: একদম গোড়ার কথায় আসি। এ্যাস এ ফিল্মম্যাকার আমি একটা সহজলভ্য গল্পের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছিলাম কি না? যেমন ঐখানে মানুষ মারা গেছে ঐখানে ছবি হইতে পারে এমন কি না, খবরের মতো। আইলা হইছিলো মে মাসে। ঐ সময় আমি আমার একটা ফিচারের স্ক্রিপ্টের কাজ করছিলাম। আর ডিসেম্বর মাসে হইলো জলবায়ূ সম্মেলন। ঐখানে দেখি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় লোক বিশাল আয়োজন কইরা যায়। আর আমি পত্রিকায় দেখি অন্য জিনিস, ছবি দেইখা আমার মনে হইতো যে শিল্পী এস এম সুলতানের ছবিতে যেমন মানুষের পেশীগুলো দেখা যায় ঐ রকম। রাত্রে মনে হইতো হাজার হাজার মানুষের পায়ের আওয়াজ পাই, মনে হইতো লাখো মানুষ ঢাকার দিকে আসতেছে! আমরা এত ইগনোরেন্ট, যে প্রায় দশ লক্ষ লোক মাসের পর মাস প্রায় বসে থাকলো, আর শহরে এইটা নিয়া কোনও হইচই নাই। ঐ অবস্থায় আউট অব কিউরিসিটি, আউট অব অ্যাঙ্গার কোনও রকম প্ল্যান ছাড়া আমি চলে গেলাম। এই যে আমি ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, চললো প্রায় তিনমাস। ভোলা থেকে সাতক্ষীরা, প্রায় দুইশো কিলোমিটার, মূলত নৌকায়। কিন্তু ঐখানে গিয়াতো আমি বোকা হইয়া গেলাম। মনে হইলো আমি একজন শহরের মানুষ, একটা শহুরে টুপি পইড়া তাদের করুনা করতে গেছি। গিয়া দেখি আমি কোন ছাড়! শহর থেকে দূরে এই মানুষগুলি মাটির সাথে এত কাছে, তাঁর শেকড় মাটির ভেতর এত বেশী গভীরে যে সে কোনও কিছুর জন্যই আর অপেক্ষা করতেছে না। মানুষের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য, তার যে সংগ্রাম ঐটাই পুরা একটা সিনেমা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চায়ের দোকানে বইসা বইসা আড্ডা মারি, এই কাজই করছি টানা প্রায় তিনমাস। ঐ সময় ঐ চাষি আমারে বলছিলো, আপনারা যারা শহরের মানুষ তারা এমন দূর্যোগে ত্রাণ না আসলে বিপদে পড়বেন। কিন্তু আমরা ঘটনার পর বাড়ি গিয়া দেখবো বীজ আছে কিনা, থাকলে প্রথমে তা লাগাইয়া দিবো। এই কথা শুইনা আমারতো মাথা ঘুইরা গেলো, মাথায় নেশা ঢুইক্যা গেলো! ফিরা আইসা ছোট ছোট করে লেখা শুরু করলাম, কোনও রকম পরিকল্পনা নাই, টাকা পয়সার কোন হিসাব নাই, পুরাই একা। কে দেখবে, কে দেখবে না… কে খাবে, কে খাবে না… এই চিন্তা ছাড়াই।

বাবু: তারেক মাসুদের ‌’আদম সুরতেও’ চাষীদের এমন কথা আছে

কামার: হ্যাঁ আপনি ঠিক বলসেন। আমি তখন খালি সহজ মানুষের সাথে কথা বলি, আর প্রত্যেকবার নতুন নতুন কথা, সহজ কথা নিয়া ফেরত আসি। আর আইসা সারারে (সারা আফরীন, সিনেমার যৌথ নির্মাতা ও প্রযোজক) বলি, সারা এইখানে কি জানি একটা গল্প আছে। কল্পনায় মাণিক বন্দোপাধ্যায়ের কুবের মাঝি আর তারাশঙ্করের কবির ছবি ভাসতে থাকে। চরিত্রগুলারেতো আর আমি দেখি নাই, কিন্তু ঐ সময় মনে হঠাৎ হঠাৎ হইতো আমার সামনে যেন কুবের মাঝি দাঁড়ায় আছে। আমার মাথাটা জাস্ট খারাপ হয়ে গেলো, ঐ সময় আমি গল্পের ভিতর ঢুইক্যা পড়সি। একভাবে বলতে গেলে গল্পটা আমি বাছাই করি নাই, বরং গল্পটাই আমারে বাছাই করসে! শিকার করতো গিয়া আমি নিজেই শিকার হইয়্যা গেসি। ছোট ছোট মানুষের অসীম সাহসের গল্প। বাইরের দেশে দর্শকরাতো ছবি দেইখ্যা সোজা হইয়্যা বসছে, আমারে বলে, ‘তুমি কি প্রোপাগান্ডা ছবি নিয়া আসছো? এই বাংলাদেশতো আমরা দেখি নাই!’ আমি হাইসা উত্তর দিসি, ‘আমিও আগে জানতাম না, এখন জানি আসলে… এইটাই আসল বাংলাদেশ।’

কমল : ছবির দর্শকের কমেন্টস যখন সরাসরি পাওয়া যায় তখন তো সেটা অনেক বড় অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে

কামার : একটু আগে আমি এই অবজেক্টিভিটির কথা বলতেছিলাম না? মানে আপনি ছবি কেন বানাবেন? একজন ফিল্মমেকার হিসাবে আমি কিন্তু প্রচলিত অর্থে জাতীয়তাবাদী না। কিন্তু নিজের মাটির মানুষের গল্পে যে মজা পাই, মেকি কাহিনীতে সেই মজা কই? আমার ছবি সেই অর্থে হয়তো সফল নাও হইতে পারে, কিন্তু ছবি বানানোর একটা স্বার্থকতাওতো থাকা চাই, নাকি!

আমি: আসলে বিষয়টা এমন যে, আমরা সব সময়ই একটা চেইনের ভিতর জীবন যাপন করতে চাই আমরা কখনোই এর বাইরের দিকটা দেখতে চাই নাফলে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষের মতোই চলতে চেষ্টা করি, আমাদের ভেতর চেইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার আগ্রহই নাই

কামার: এইটা আমাদের সিস্টেমের দোষ। জন্মের পর থেকেই আমাদের ভিতর বিভিন্ন ভাবনা পুষ-ইন হইতে থাকে, চাহিদা পুষ-ইন হইতে থাকে। ক্লাসে ফার্স্ট হইতে হবে, কোরবানীর বড় গরুটা আমার চাই, দামী মোবাইল না থাকলে জীবন বৃথা… নানা রকম লোভ আমাদেররে সিস্টেমের ভিতর নিয়া আসে, একবার ঢুকলে বাইর হইতে কষ্ট আছে… কিন্তু অসম্ভব না।

প্রশ্ন: কেন ছবির নাম ‘শুনতে কি পাও’?

কামার: এই প্রশ্নটা আমার খুব পছন্দের। আপনি তো ছবিটা দেখছেন। ছবিটার এই যে চরিত্রগুলা রাহুল, রাখি, সৌমেনসহ একগ্রাম মানুষ… তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতগুলো কি? এইটারে আমি মনে হইসে স্রেফ ‌‘সেলিব্রেশন অব লাইফ’ বা সহজ কথায় বলতে পারি ‘জীবনের জয়গান’। জীবনটা যে কত সুন্দর আর কত বিচিত্র, তা যে উদযাপন করা যায় তা আমি ঐখানে গিয়া রিয়ালাইজ করছি। আমিতো সেখানে প্রথমবার এক ধরনের রাগ নিয়া গেছিলাম, কিন্তু পরেতো আমি বোকা হইয়ে গেলাম। সহজ মানুষ, সত্য মানুষের যে কি সাহস, কি শক্তি সেইটা আমি ঐখানে গিয়া বুঝছি… শহরের মানুষ হিসাবে আমার যেইটার বরই অভাব! আমি যদি এই গ্রামটায় না যাইতাম, তাইলে আমার বোধটাই অপূর্ণ থাইক্যা যাইতো। একটা সময় এমন হইছে, আমি স্যুটিং থামাইতে পারতেছি না, একদম দিওয়ানা হইয়া গেলাম একরকম… মনে মনে ভাবলাম, জীবনের এই যে জয়গান আমি শুনলাম, সেইটা কি আমি দর্শকরে শুনাইতে পারবো? দর্শক কি শুনবে এই গান? আমি জানি না… তাই সেই থেকে নাম দিলাম, ‘শুনতে কি পাও!’

 

কমল : এই অবস্থায় এজ এ ফিল্মম্যাকার আপনার কাছে তথ্যচিত্রের মজা বেশী বলে আপনিই উল্লেখ করছেনতো এই অবস্থায় আপনার কি ফিচার ফিল্ম বানানোর সম্ভাবনাটা আসলে কমে যাইতেছে?

কামার : আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে ডকুমেন্টারি বানাই নাই। তাই আমি বোধহয় ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে ফিচারও মনে হয় বানাইতে পারবো না। আমি ঐভাবেই ছবিটা বানাইতে চাই যেইটা আমি ফিল করবো আমার মাঝে ভেতর থেকে। এই অবস্থায় আমার মনে হয় আমি যদি ডকুমেন্টারি বানাই, তবে তা ফিকশনের মতো হবে।

কামার : আপনার ছবির শুরুতেই আমরা দেখি রাহুল আর তার মা রাখীর একটা মানবিক অবস্থা তুলে ধরলেনআবার একটা সময় গিয়ে দেখি গ্রামের মেম্বারকে জবাবদীহিতার মুখে পড়তে হচ্ছেএই যে মানবিক জীবন থেকে রাজনৈতিক জীবনে গিয়ে আপনি দাঁড়াইলেন, এইটার সাথে সমাজ জীবনকে রিলেট করলেন কিভাবে?

কামার : দেখেন, আপনি শিল্পের যেই মাধ্যমেই চেষ্টা করেন আপনার ভেতরে যদি কোন সমাজদর্শণ কাজ না করে, ব্যক্তি মানুষের সংকট ও সামষ্টিক মানুষের যে দ্বান্ধিকতার মাঝে আমরা বাস করি… সেইটা আপনি যদি চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন, তাইলে আর সিনেমা বানাইয়া লাভ কি? এরতো কোন অবজেক্টিভিটিই থাকে না!

কমল : ছবিতো শেষ পর্যন্ত একটা পণ্যও

কামার : যেহেতু ছবি ভোক্তা খোঁজে… সেহেতু ছবি অবশ্যই পণ্য। সেই অর্থে কবিতাও তো পণ্য! তো এখন এই পণ্যের বাজারে এর ভেতর দুইটা একটা খোটা পণ্য তো থাকবেই, সময়-অসময়ের দাগ তাতে লাগবেই। সাদা চুল কালো করতে লাগে কলপ, কালো চেহারা ফর্সা করতে লাগে ক্রীম… জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে লাগে ছবি, জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি। আসলে কি জানেন, কোনও সৎ শিল্প চেষ্টা কখনোই তার সময়টাকে অস্বীকার করতে পারে না। সময়ের দর্শন, রাজনীতি, সংকট আর ব্যাক্তির জীবনে তার দ্বন্ধ চিরকালই ভালো শিল্প সৃষ্টি করেছে।

কমল : অসৎ শিল্প প্রচেষ্টা আপনি কোনটাকে বলছেন?

কামার : আমি যদি ছবিটা বানানোর প্রথম থেকেই ভাবতাম যে এইটা চলবে কি না? যদি ভাবতাম এইটাকে কিভাবে আরো চালানো যায়, আরো চালু জিনিস যেমন দারিদ্র, কান্না, দুর্যোগ ঢোকানো যায়… আপনিতো শুরুতেই আইলার কথা উল্লেখ করলেন, তো পুরা ছবিটাতে আইলার কিছু দেখছেন? এইখানে আইলা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড, একটা উপলক্ষ মাত্র। ধরেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর ছবি হইছে, লাতিন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকট নিয়া কত ছবি হইছে। একজন সৎ নির্মাতার কিন্তু এইগুলা এড়াই যাওয়ার সুযোগ নাই। আপনার সামনে এমন ঘটনা ঘটতেছে অথচ আপনি একটু মশলা দিয়া চালু একটা সিনেমা বানাইলেন, এইটাই হচ্ছে অসৎ চেষ্টা। যেমন ধরেন, একাত্তর থেকে বাংলাদেশের চার দশকের সিনেমার কথাই যদি ধরি- প্রথম দশক এক ধরনের কুহেলিকার সময়ই গেলো বলতে গেলে। এক ধরনের নেতৃত্বহীন একটা অবস্থা। পরের দিকে দ্বিতীয় দশকে আলমগীর কবিরের মতো সিনেমা নির্মাতা আসলো। আশির দশকে শর্ট ফিল্ম ফোরামের মতো মুভমেন্ট, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, জাহিদুর রহমান অঞ্জন, শারমিন আক্তারের মতো এক ঝাঁক নতুন নির্মাতারা এর মধ্য দিয়া আসলো। সেখান থেকে আপনি সুলতান (আদম সুরত), সেখান থেকে মুক্তির গান, পরবর্তিতে পাইছেন মাটির ময়না’র মতো ফিল্ম। এইটা গেলো দ্বিতীয় দশক, তৃতীয় দশকটা মানে নব্বইয়ের দশক আমার কাছে মনে হয় ফ্যাস্টিভ্যালের দশক। এখন আসি চতুর্থ দশক, শূণ্যের দশকে। ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে আমরা অনেক প্রমিজিং নির্মাতার কথা শুনলাম। যারা কমবেশী বিভিন্নভাবে ছোটবাক্সের হাতে একরকম অজান্তেই বন্দী হয়ে গেলো। অসাধারণ গুণী দু’একজন নির্মাতা যেমন সেলিম ভাই (গিয়াসউদ্দিন সেলিম), আতিক ভাই (নুরুল আলম আতিক), অনিমেষ আইচ এরা একের পর এক ভালো ভালো কাজ করলেও গড়পরতা নির্মাতাদের জন্য এটা অনেকটা দিন এনে দিন খাওয়ার মতো বিষয় হয়ে গেলো। ঐটা করতে গিয়া শূণ্যের দশকটা এক অর্থে অলমোস্ট গায়েব হয়ে গেলো। আপনি বলতে পারেন ২০০২ এ ‘মাটির ময়না’ হইছে, ‘মনপুরা’ হইছে। কিন্তু শুন্য দশকে এইগুলা নির্মাণ হইলেও এদের বীজ বপন ছিলো আশির দশকে। এখন এই শূন্যের দশকে শত শত তরুণ নবীন যারা আসলো, তারা এই প্রক্রিয়াগত সময়ে না ঢুইক্যাই, কর্পোরেট আর চ্যানেলের যোগসাজসে বিজ্ঞাপন আর নাটকের প্রোডাক্টিভ পাইপলাইনে ঢুইক্যা গেলো। এখন এইটাকে অসৎ বলবো না, কিন্তু শিল্পের এই বাণিজ্যিক চাপ যে খুব সৎ ছিলো তাও কিন্তু বলা যাবে না।

 

কমল: এইটা নিঃসন্দেহে হতাশার বিষয় যে, আমরা যাদের সম্পর্কে জানতাম এরা ভালো নির্মাতা হইতে পারে তাদের কাছ থেকে সিনেমায় তেমন কিছু আমরা পাই নাই

কামার: দেখেন পাঁচজন নবীন নির্মাতা যদি এই দশবছরে দুইটা কইরা ছবি বানাইত পারতো, তাহলে আজকে আমাদের কাছে অন্তত বলার মতো দশটা নতুন ছবি থাকতো।

বাবু: আপনার ছবি দেশে প্রথমবারের মতো কোনও তথ্যচিত্র হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তিপেতে যাচ্ছেআপনার কি মনে হয়, আমাদের দেশের দর্শকরা একটা তথ্যচিত্র বাণিজ্যিকভাবে হলে গিয়ে দেখার মতো প্রস্তুত হয়েছে?

কামার: আমার ছবিটা নিয়া একটা মজার বিতর্ক চলতেছে। ডকুমেন্টারি নির্মাতারা বলতেছে এইটা ফিকশন, আবার ফিকশন নির্মাতারা বলতেছে ডকুমেন্টারি, আমি বলতেছি সিনেমা। আল্টিমেটলি এইটা কি সেইটা নির্ধারণ করবে দর্শক। আমি তাদের উপরই ছেড়ে দিবো বিষয়টা। দর্শক কিন্তু আসলে আগে থেকে নতুন কোন কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকে না, কিন্তু আপনি দিলে দর্শক কিন্তু ভালো মন্দ ঠিকই বুঝে কম বেশি হয়, একটু সময় লাগে, এই আরকি।

কমল: এইখানে যেইটা হইছে বইলা কি আপনি মনে করতেছেন, যারা এই তর্কটা করতেছে তারা কেউ ছবিটার ভেতর ঢুকতে পারে নাই

কামার: কিন্তু দর্শকের এই বিতর্কটা করার অধিকার আছে।

কমল: দর্শক তখনই যখন সে ছবিটা দেখবেছবি না দেখলে সে ছবির দর্শক নাতখন সে নিশ্চয়ই এইটা ডকু না ফিকশন সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারে না

কামার: হ্যা, না দেখে কমেন্ট করলে সেটাও নির্মাতার প্রতি অন্যায় হবে।

কমল: দৈনিক পত্রিকা মারফত যখন আমরা এই ছবির খবর পাই, তখন আমি কিছুটা কনফিউজডআসলে এইটা কি? ডকু না ফিচার এই বিষয় নিয়া আমার নিজেরো তখন কনফিউশন ছিলো

কামার: কেউ যদি ছবি না দেখে এইটা ডকু না ফিচার সেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় তারে অনগ্রসর দর্শক বলবো আমি। আমি মনে করি, একজন দর্শক ছবির মজাটাই দেখবে। এখন একজন দর্শকরে আমি আমার সিনেমার সামনে বসাইয়া দেয়ার পরে যদি সে ভিতরে না ঢুকতে পারে তাইলে আমি ফেইল্যুর, আর যদি আমি তার জীবন থেকে নব্বই মিনিট নিয়ে নিতে পারি তাহলে এইটা সিনেমা। সহজ হিসাব।

বাবু: ডকু ড্রামার যে বিষয়টা আছে, যেমন ধরেন নানুক অব দ্যা আর্থ কিংবা দ্যা লুজিয়ানো স্টোরি- ঐ রকম কিনা বিষয়টা?

কামার: সেইটা আমি কেন বলতে যাবো? সেটা দর্শকের সিদ্ধান্ত।

কমল: আপনার ছবির বিষয় যদিও দুর্যোগাক্রান্ত অঞ্চল, যদিও আপনার ছবিতে দুর্যোগটা মূখ্য বিষয় নয়, আপনি বলছেন যে আপনি শুনতে পাচ্ছিলেন দলে দলে মানুষ কাজের খোঁজে শহরের দিকে আসতেছেতো আপনি যে ছবিটা দুর্যোগাক্রান্ত মানুষ নিয়ে বানাইলেন এর আগে আপনার কি কোনও রিসার্চ বা গবেষণা ছিলো না একদম মানবিক জায়গা থেকে ইনভল্ব হয়েই ছবিটা বানানো?

কামার: আগে থেকে কোন প্রস্তুতিই ছিলো না, আমি আমার ফিচার স্ক্রিপ্টে কাজ করতেছিলাম। এইটা এক ধরনের আলোর পোকার মতো। আমারে টেনে নিয়ে গেছে বিষয়টা।

প্রশ্ন: একটু আগেও উল্লেখ করছি আবারো তাই বলা, যে আপনার ছবির সফলতার খবর দিয়েই আমরা ছবি সম্পর্কে প্রথম জানি তো আপনি প্যারিসে গ্রাঁপি‘ পর্যন্তও পাইলেন আবার মুম্বাইয়ে স্বর্ণশঙ্খ‘ও পাইলেনতো আপনার ছবির এই সফলতা বাংলাদেশের ছবিতে কি প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন? আর একটু যোগ করি তারেক মাসুদের মাটির ময়না যখন কান ফ্যাস্টিভ্যালে গেলো সেখানে পুরস্কার পাওয়ার পর ছবির প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ দেখা গেলোতো এই ক্ষেত্রে আপনার ছবির এই সফলতা কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা?

কামার: নিঃসন্দেহে তা দর্শকদের উপর প্রভাব ফেলবে। পণ্য যেহেতু তার ভোক্তার ওপর নির্ভরশীল। এখন পণ্যের চাহিদা তৈরির জন্য তো ভোক্তাকে আকৃষ্ট করতেই হবে। তবে ‘গ্রাঁপি’ অথবা ‘স্বর্ণশঙ্খ’ পাওয়াসহ অন্য যে সব পুরস্কার আমরা পাইছি, তাকে আমি কাকতালীয় ছাড়া কিছু বলতে পারবো না। কারণ, যারা ছবিটা দেখবেন, তারা বুঝবেন ছবিটা পুরষ্কার পাবে এইটা মাথায় নিয়ে বানানো সম্ভব না। আমার ছবিটা যেখানে প্রিমিয়ার হইছিলো জার্মানির লাইপজিগে। পৃথিবীর প্রাচীণতম ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে উদ্বোধনী ছবি ছিলো এইটা। এরপর থেকে প্রায় বিশটার মতো ফ্যাস্টিভ্যালে যে গেছে তার সবগুলোই তাদের কাছ থেকে সরাসরি আমন্ত্রণে। আপনি একটু চিন্তা করে দেখেন, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ যদি কান ফ্যাস্টিভ্যালে পুরস্কার না পাইতো বা আলোচিত না হইতো, তাইলে কষ্ট হইতো এইটা দর্শকদের কাছে নিয়ে যাইতে। পরবর্তীতে হয়তো দর্শক দেখে বলতো এইটা ভালো না, পুরস্কার ছবি সম্পর্কে এক ধরনের রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। আজকে গার্মেন্টস শিল্পের দিকেই তাকান না কেন। একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী গর্ব বোধ করে যে আমি এক্সপোর্ট করি। আবার আপনি যখন এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জিনিস কিনেন তখন আপনিও গর্ব বোধ করেন যে আমি এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জিনিসটা ব্যবহার করি। হা হা হা

কমল: এই ছবি যদি ব্যবসায়িক ভাবে দর্শকদের মাঝে সাড়া ফেলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সিনেমায় কি প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

কামার: আমি তো মনে করি তরুণ যারা সিনেমা নির্মাতা আছেন বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতা, সংকটের কথা বলেন তারা আর এক্সকিউজ দেয়ার সুযোগ পাবে না। আমি যেই টাকায়, যেই সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ছবিটার কাজ শেষ করছি এইটা যদি দর্শকরা নেয়… তাহলে তরুণ নির্মাতারা যারা ঘরে বসে নানা রকম স্বপ্ন দেখছে তারা ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাবে। তারা তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নক করবে। বলবে যে দেখেন এই যে আমার একটা সিনেমা আছে। এই সাহসটা কিন্তু খুব ইম্পোর্টেন্ট। আমরা কোনও কারণে এই সাহসটা পাচ্ছি না। সবাই আগেই ধরে বসে আছে, আমার ছবিটা বানাইতে পারবো না, বানাইলেও চালাইতে পারবো না, হবে না, ইত্যাদি। এই সংকটের মধ্যে আমি যে ছিলাম না তা তো না। তারেক মাসুদের এই সংকট ছিলো, আলমগীর কবিরেরও এইটা ডিল করতে হইসে, কিয়রোস্তামিও এর মধ্যেই বসবাস করে। এটা নির্মাতার জন্য নতুন কোনও সংকট না। কিন্তু এখন যদি এই ছবিটা দর্শকদের মাঝে সেই প্রভাব ফেলতে পারে তাহলে আপনার আমার মতো শত শত তরুণ যারা স্বপ্ন দেখছি ছবি বানিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনবে সেই জায়গাটা অনেক বড় হয়ে যাবে।

কমল: আপনার স্যুটিং প্রসেসটা কেমন ছিলো?

কামার: প্রথম তিনমাসে আমি একটা লোকেশন, একটা গ্রাম আর চরিত্রগুলো নিশ্চিত করসি। তারপর থেকে ছয় মাস বলতে গেলে আমি এই ছয় মাস নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার ভিতর দিয়া গেছি, একরকম সেল্ফ গ্রুমিং প্রসেসের মাঝ দিয়ে গেছি।  কাস্টদের সাথে প্রতিদিন ওঠা-বসা করা, খাওয়া-দাওয়া করা, তাদের চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার ভিতর দিয়া গেছি। এই সময়ে আমি দেখছি যে এই ছেলেটা এমন করে চলে এমন করে ক্যাপ পড়ে, তখন আমি তারে বলছি যে আমি যখন স্যুট করবো তখন তুমি কিন্তু দাঁড়ি রাখবা। তখন সে দাঁড়ি রাখছে। তবে আমি কোনও কিছু চেইঞ্জ করি নাই। এই রকম ছোট ছোট কাজ করে করে আমি ঐ লোকেশনটাকে গ্রুম করছি, ইউনিটকে গ্রুম করছি। পাশাপাশি এক ধরনের স্ক্রিপ্ট করছি। ছবির মাঝে একটা ন্যারেটিভ আছে, যারা ছবিটা দেখবে তাদের জন্য বিষয়টা ছবিতে আছে তাই এখন বলছি না। ছবির একটা জায়গায় গিয়ে যাত্রাটা শেষ হয়। এই যাত্রা শেষটা আপনি দুই বছর আগে প্রেডিক্ট করতে পারবেন না যে দুই বছর পরে এইটা হবে। এই ঘটনাটা পাঁচ বছর পরেও হইতে পারে, দশ বছর পরেও হইতে পারে আবার নাও হইতে পারে। যেইটা আমি প্রেডিক্ট করছি যে এই পরিবারটা এরকম হবে, এই গ্রামটা এরকম হবে এই মানুষগুলো এরকম হবে। এইভাবে মানুষের বিভিন্ন চরিত্র আর দিনের গল্পকে চিন্তা করে ছোট ছোট সিকুয়েন্স লিখছি। যে চায়ের দোকানে এমন একটা বিষয় হবে, তারপর দেখলাম তাদের মধ্যে এই ঝগড়া হয়, বাচ্চাদের মধ্যে এই রকম কথা হয় এইসব আমি লিখলাম। এইসব করতে করতে যখন আসল স্যুটিংটা শুরু হইছে ততদিনে ছয় মাস কিন্তু চলে গেছে।

কমল: তাইলে প্রথম তিনমাসে আপনি গ্রামটা আবিষ্কার করলেন, পরবর্তি ছয়মাস আপনি আপনার গল্পের ধারাবাহিকতা আর চরিত্রগুলোকে সাজাইলেনতারপর আপনি স্যুট করলেন?

কামার: এক্সেক্টলি। এই ছয় মাসও আমি ক্যামেরা নিয়ে গেছি। কিন্তু এই ছয় মাসের পর সব কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে আসছে। বলতে গেলে ফিকশনের প্রসেসেই এইটা করা হইছে।

বাবু: কত দিন স্যুট করলেন?

কামার: ঐ ছয় মাসসহ প্রায় বিশ মাসের প্রোডাকশন, যাওয়া আসার মধ্যে ছিলাম। কখনো চারদিনেই চলে আসতাম আবার কখনো টানা চার সপ্তাহও চলসে।

 

বাবু: ঐ আগের ছয় মাস প্রি-প্রোডাকশন হিসেবে কাজ করছে

কামার: হ্যা, ঐ ছয় মাসকে প্রি-প্রোডাকশন টাইম বলা যায়। ঐ এলাকার ভাষাও তো শিখতে হইছে প্রথমে। আমার ছবির প্রত্যেকটা চরিত্রের ক্যারেক্টার সার্কেল আমাকে তৈরি করতে হইছে। এইসব করতে গিয়া আমি কখনোই ভাবি নাই যে ডকুমেন্টারি করতেছি না ফিকশন করতেছি। যতদিন আমার ভাল্লাগছে ততদিনই আমি স্যুট করছি। কারণ আমারে তো কেউ বলার কেউ নাই যে আপনি ডকুমেন্টারি বানাইতেছেন না ফিকশন বানাইতেছেন? আর আমি এইসব কেয়ারও করি নাই।

কমল: টিম ম্যানেজম্যান্টটা কেমনে করলেন?

কামার: টিম ম্যানেজম্যান্ট নিয়া আমার প্রচুর ভুগতে হইসে। প্রথমদিকে যখন কাজ শুরু করছি তখন অনেকেই খুব উৎসাহ নিয়া আসছে। ঐখানে কাঁদার মধ্যে বইসা খাওয়া দাওয়া, টয়লেট ছাড়া, যখন রাস্তার ওপর ঘুমানোর ব্যবস্থা দেখে তখন পরের দিনই সবাই পালাইয়া যায়। প্রত্যেকবারই আমি যাই আর প্রত্যেকবারই দুইটা একটা কইরা পালাইয়া যায়। আর যারা ফিরে আসে তারা ফোন ধরা বন্ধ কইরা দেয় এই রকম একটা কাণ্ড। এই রকম একটা পর্যায়ে আমার অনেক দিন গেছে। এই অবস্থায় গ্রামের কিছু ছেলেরে আমি ট্রেইন-আপ করে নিছিলাম। ওরা স্যুটিং এর প্রোডাকশন ম্যানেজম্যান্টটা শিখে গেছিলো। তারা জানে টাইম টেবিল কি, খাওয়ার শিডিউলটা কি হবে। ছয়টা সময় কল টাইম মানে ছয়টা সময় নৌকাটা ঘাটে রেডি থাকবে। এইভাবে ঐখান থেকে একটা লোকাল প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে গেছে আমার। ঐখানে আমাদের একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলো যে কিনা আমরা যাওয়ার আগে সবকিছু ঠিকঠাক করতো, একজন বাবুর্চি ছিলো সে রান্না করতো। ঐখানে তো ইলেক্ট্রিসিটি নাই। আমি ট্রাকের ব্যাটারি দিয়া আমি আইপিএস বানাইয়া নিয়া গেছি। একটা ছেলে ছিলো আমাদের জেনারেটর ঠিকঠাক করতো, আইপিএস রিচার্জ করতো। শেষের অংশটা ওরাই সাপোর্ট দিছে পুরাা।

বাবু: বাজেট কেমন ছিলো?

কামার : টোটাল ছবির? ছবির বাজেট তো এখনো চলতেছে। এই যে সিনেমা হলে যাওয়ার জন্যও তো আমার কাজ করতে হইতেছে। আমার এখন পর্যন্ত যে খরচ হইছে তা যদি আমি বলি তাহলে লোকজন আমাকে ভুল বুঝবে। দেশব্যাপী দেখাব বলে একটা ২কে এইচডি প্রজেক্টর কিনছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড়-যন্তর করে, অনেকের কাছ থেকে ধার নিয়ে, স্পন্সর নিয়ে। দেশব্যাপি দেখানো শুরু করব হোপফুলি ২১ শে ফেব্রুয়ারীর বসুন্ধরায় রিলিজের পর, এর জন্য আবার লাখ টাকা খরচা খরচ কইরা মুম্বাই থেকে ডিসিপি করে আনলাম। আমার খরচ হিসেবের বাইরে চলে গেছে। কিছু গ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ড পাইছি, সারা’র কিছু পারসোনাল সেভিংস ছিল, কিছু নানান জায়গা থেকে ধার করে, আমিও বলতে পারব না কত টাকা আসলে খরচ হইসে… কোটি ছাড়ায় যাবে। ফিকশনের ক্ষেত্রে বা নেক্সট প্রোজেক্ট যেগুলো করতেছি সেগুলো একদম প্রথম থেকে বাজেট করছি। এইটার সুবিধাও আছে, আবার অসুবিধাও আছে। আগে ফোঁড়া কাটা চিকিৎসক ছিলাম কেটে ফেলছি, (হাসি) এখন তো ফোঁড়া কাটতে পারছি না। এখন বসে বসে হিসাব করছি আর ভাবছি এইটা তো এই টাকায় হবে, ওই টাকায় হবে না।

কমল: আরেকটা বিষয়ছবির টোটাল দুইটা জায়গায় আমি মজা পাইছিসিনেমার যেই ইমেজ এবং সাউন্ডআমার ধারনা ছবির পোস্ট প্রোডাকশন বেশ সময় দিছেন

কামার: ইমেজে আর শব্দইতো সব… ইমেজে কালার গ্রেডিঙ্গ করা হইছে, সাউন্ড পোস্টে রিডিজাইন করা হইসে। এছাড়াতো আমি আপনারে এক্সপ্রেস করতে পারবো না, একটা উদাহরণ বলি… শুরুতে না দিন না রাত এমন একটা মুহূর্ত আছে ছবিতে। এখন উপন্যাস হইলে আপনি লিখে দিতেন, মাহেন্দ্রক্ষণ… অর্থাৎ না দিন, না রাত; আপনার কাজ শেষ মাত্র চার শব্দে। কিন্তু ছবিতে কিভাবে আনব, ছবির শুরুতেই আপনি একটা দৃশ্যে দেখবেন না দিন না রাত। আকাশে ছোট্ট একটা চাঁদ আছে, সেটা মেঘ আস্তে করে ঢেকে দিচ্ছে। এইটা তো দুর্ঘটনা না, তবে চাঁদটা মেঘ ঢেকে দিচ্ছে সেটাকে লাক বলতে হবে।  জোয়ার ভাটা প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে শিফট হয়। এখন ঠিক সন্ধ্যার সময়, না জোয়ার না ভাটা এইটা প্রায় ২ মাসে একবার ঘটে। এর মধ্যে একটা অঙ্ক আছে। আমি দুই তিন বার ফেল করছি। আমি ৪টা থেকে শুট করছি, বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে তখন পুরা পানি। আমি সেটা চাই নাই, আবার অন্য দিন সারে পাঁচটা বাজে পুরা শুকনা আমি সেটাও চাচ্ছি না, আমি চাচ্ছিলাম একটু কাদা কাদা পানি। এর জন্য আমার টিম মেম্বাররা বিরক্ত হয়ে বলছে, আপনি কি শুরু করছেন? চার ঘণ্টা ধরে কয়বার স্যুট করব এইটা? আমি বসেছিলাম। ফাইনালি, আমি ওই শট টা পাইছি, এখন আমি আনন্দ নিয়ে আপনাকে এই কথাটা বলছি। এক্সিডেন্টালি পাওয়া সম্ভব না। সাউন্ড এ কাজ করতে গিয়া অনেক সাফার করছি, পরে লোকেশন থেকে রিকভার করার চেষ্টা করছি। আমি যে শব্দগুলো কানে নিয়ে ফিরত আসছি, সেগুলো আমি পাই নাই। সেগুলো আমার রি-এরেঞ্জ করতে হইছে। কিন্তু শব্দ বিষয় সিনেমার জন্য অনেকটা গন্ধের মতো, একটা বৃষ্টির শব্দ যদি কারেক্টলি হয় আপনার কিন্তু লোম দাঁড়াবে,  সেনশেসন কাজ করবে। শব্দকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। একটা খারাপ ইমেজের ভালো শব্দের ছবি কিন্তু আপনি দেখতে পারবেন। কিন্তু একটা ভালো ইমেজের খারাপ শব্দের ছবি আপনি দেখতে পারবেন না। ওইটা ভেরি ইরিটেটিং। শব্দকে যতটুকু সম্মান জানানো যায়, সেটা চেষ্টা করছি, সাউন্ড এ এক্সপেরিমেন্ট করছি পুরো নেচারের সাউন্ড নিয়ে। বাতাস, আলো, সূর্য, পাতা এসব নিয়ে। যদিও ফাইনাল মিক্সিঙটা নিয়া এখনও আপত্তি আছে, যেমনটা ভাবছিলাম তেমন করতে পারি নাই, তবে ভুলের জায়গাগুলা আইডেন্টিফাই করসি, পরের কাজে লাগবে আশা করি।

কমল: আপনি বললেন যে, একটা মোমেন্ট এর জন্য ওয়েট করছেন কিন্তু পাচ্ছেন না, তখন কি আপনার হতাশা কাজ করছে?

কামার: ওরে… বাবা। (হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ )… পুরাটাইতো! এখন পর্যন্ত কষ্ট দেয় এরকম একটা আফসোসের কথা বলি। লোকেশান টা হল ভদ্রা নদীর পারে। আগেও দুই একজায়গায় বলছি, সারা (সারা আফরীন, প্রযোজক) জানে। আমি দেখতে পাই দূরে বৃষ্টি হচ্ছে, কালো হইছে। এবার মেঘটা ঘুরে ঘুরে নদীর উপর দিয়ে বৃষ্টিটা গ্রামটায় আসে। এইটা আমি কয়েকবার দেখছি কিন্তু শুট করতে পারি নাই। কয়েকবার চেষ্টা করেও নানান কারনে শুট করতে পারি নাই। আপনি দেখতে পাচ্ছেন নদীর উপর দিয়ে মেঘ এসে বৃষ্টি হচ্ছে। রুপালি নদিটা কালচে হয়ে গেছে, উপরে একটু ছায়া পড়ছে। নদীর উপর বৃষ্টি ঘুরে ঘুরে আসে সেটা আমি জানতাম না। এটা দারুন একটা ব্যাপার কিন্তু আমি শুট করতে পারি নাই। যারা ছবিটা দেখবেন তারা বুঝবেন, আমার মতো করে আমি বৃষ্টিকে ফিল্মের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করসি। ছবিটাতে বৃষ্টির কিছু কথা আছে, আশা করি দর্শকরা সেটা শুনতে পাবেন, বুঝতে পারবেন।

কমল: ছোটবেলা থেকে কোন সিনেমাগুলো আপনার উপর প্রভাব ফেলছে?

কামার: সিনেমার প্রভাব অনেক ছোটবেলা থেকে। মাথার মধ্যে একটা পোকা ঘুরতে ছিল, সেটা অনেকদিন ভোগাইলো। অনেকদিন সাহস দেয় নাই, অনেক দিন মনে হইছে আর হবে না। অনেকদিন মনে হইছে জীবন শেষ। এইভাবেই অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি। অনেকগুলো সিনেমা আছে যেগুলো আমাকে সাহস দিছে। তার মধ্যে একটা হল, খুব পরিচিত ছবি আশা করি কম বেশি সবাই দেখছেন… সিনেমা প্যারাদিসো। আরেকটা হল কুরোসাওয়ার ড্রিম। আমার তো অনুভূতি আছে, আমি মানুষ তো। আমার তো সেনশেসন আছে। এই সিনেমা দেখে আগের মানুষটাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে তো হবে না। এই সিনেমাগুলো দেখার পরে কিছু একটা হয়ে গেছে, ছবি কয়টাই এমন ছিল। কিন্তু ড্রিম ছিল শেষ সিনেমা যার প্রভাব আমার মধ্যে খুব বেশি কাজ করছে। আমার মনে হয় পৃথিবীর আল্টিমেট সিনেমাটা বানানো হয়ে গেছে এবং সেই সিনেমাটা দেখানো হয়ে গেছে। এখন যাই পারি ছবির ভাষায় যদি কিছু বলতে পারি।

কমল: আপনি যখন আর্কিটেকচার এ পড়াশোনা করতে গেলেন তার আগে থেকেই তো আপনার ভিতরে সিনেমার পোকা ঢুকছিলো?

কামার: একটা মজার ঘটনা বলি, এইচ.এস.সি. পড়ার সময় পাবলিক লাইব্রেরিতে ৭ দিনের একটা চাইনিজ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হইছিল। আমি একদম এক্সিডেন্টালি গেছি, ঠিক যেমন আমি সুতারখালিতে (শুনতে কি পাও-এর লোকেশন) গেছি। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা টানা সিনেমা দেখলাম, ৭ দিন, একটাও সিনেমাও মিস করি নাই। মনে হইছে, আমার ফেইট (fate) আমাকে টান দিয়ে নিয়ে বসাইয়া দিছে, এটা এক্সিডেন্টালি! ক্যাফেতে তখন দশ টাকায় একটা তেহারি পাওয়া যাইত, সেটা খেয়ে আবার সিনেমা দেখতে যেতাম। অদ্ভুত সুন্দর সব ছবি, ‘ব্যালাড অফ এ ইয়োলো রিভার’, ‘রেড সোরগাম’… কোনটা কমিক, কোনটা এ্যাকশন, কোনটা রোমান্টিক। ওইটা ছবির জগতে প্রথম এ্যানকাউন্টার ছিল, এর আগে আমি ‘পথের পাঁচালি’ দেখছিলাম ক্লাস নাইন এ থাকতে। এবং ওটা যে ডোজ হয়ে গেছিল সেটা জানতাম না। তারপর বুয়েট-এ পড়ার সময় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টানা দেখলাম ঢাকার ফেস্টিভালগুলা।

কমল: আপনার সাথে তারেক মাসুদের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল, আমরা কি ধরে নিবো আপনি তার দ্বারা অনুপ্রাণিতএটা নিয়ে আপনি কি বলবেন

কামার: আমি তারেক ভাই দ্বারা শুধু অনুপ্রাণিতই না, তারেক ভাই না থাকলে আমি হয়তো ছবিতেই থাকতামই না। এর চেয়ে সহজ ভাষায় আর বলা যায় না। আমার মনে আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এফডিসিতে গেছিলাম। তারপর যে কোন কারনে খুব সেন্টু (মানসিক ধাক্কা) খেয়ে বের হয়ে গেছিলাম। মনে মনে ভাবছি, আমি আর এই জগতে থাকব না। তারপর ইউনিভার্সিটি শেষ করে অনেকদিন পরে বলাকায় স্ক্রল দেখছি দেখছি মাটির ময়নার। তখন আমি সারাকে বললাম “সারা এই লোকটা কে?” এই লোকটার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তারপর মাটির ময়না দেখার পরে মাথায় আসলো, এই ছবি যদি বাংলাদেশে বানানো যায়?  তার আগে কিন্তু সিনেমা করব না বলে সিদ্ধান্ত নিছিলাম। মাটির ময়না এত রেস্ট্রেইন এত শাটল ফিল্ম বানানো যায়! সেই ২০০২-এ তারেক ভাইয়ের সাথে তার বাসায় ঢুকলাম, তারপর ২০১১ এর ১২ অগাস্ট পর্যন্ত তারেক ভাইয়ের সাথে একটা যোগাযোগ ছিল। এমনকি ওনার মেইলের পাসওয়ার্ডও আমার কাছে ছিল, সম্পর্কটা এই রকম ঘনিষ্ঠ ছিল।

আরেকটা বিষয় কি এখন কেউ কেউ কিছুটা প্রশিক্ষণ নিয়ে, আবার কেউ প্রশিক্ষণ না নিয়েই ছবি বানাতে বাসছে। কিন্তু প্রশিক্ষণের বাইরে, টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর বাইরে ক্যামেরা, এডিটিং, ম্যাক বুক, 7d, 5d এসবের বাইরে ছবি বানানোর মনস্তাত্ত্বিক যে জগতটা সেখানে আপনি যেই গানটা গাইবেন বা আপনি যেই সুরে গাইবেন সেটাও প্রস্তুতিমূলক প্রক্রিয়াগত। যে জায়গা সেটা একটা মানুষের কোত্থেকে হচ্ছে বা কিভাবে হবে? এইটা দুইভাবে সম্ভব, এক হচ্ছে সে স্বশিক্ষিত হতে পারে যেমন বই পরে, সিনেমা দেখে, সরাসরি সামাজিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে, শিল্প আন্দোলন আরও অনেক আন্দোলনের অথবা ডিবেটের মাধ্যমে। আরেকটা হল গুরুমুখি শিক্ষা। একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার জ্ঞানটা গ্রহণ করে…। এখন ঠাণ্ডা মাথায় যদি দেখেন আমাদের এখানে ষাট এর দশকে জহির রায়হান এর কথা এবং তার ‘কখনো আসে নি’ আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো ছবি। এবং ৭১’এ জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী ছিলেন আলমগীর কবির এবং স্টপ জেনোসাইড এর ভয়েস ওভার-ও কিন্তু আলমগীর কবিরের দেওয়া। আলমগীর কবির তার মতো একটা জায়গা তৈরি করলেন এবং যেখান থেকে তারেক মাসুদের মতো নির্মাতারা তৈরি হলেন… এটা কিন্তু একদিনের যাত্রা না। আলমগীর কবির সূর্যকন্যা বানাইলেন ১৯৭৫ সালে আর শর্ট ফিল্ম ফোরাম এর প্রথম ফেস্টিভ্যাল হইল ‘৮৬ সালে। এইটা কিন্তু ১১ বছরের যাত্রা। তারেক ভাইদের সাথে পরিচয় ১৯৮১ সালে ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট নামে একটা সংঘটন করে ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স করাইছিলেন। প্রথম ব্যাচ এর স্টুডেন্ট ছিলেন এই তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম এবং তারেক মাসুদ এবং মানজারে হাসিন মুরাদ এরা সবাই। ৮১ সালে শর্ট ফিল্ম ফোরাম এর সাথে যুক্ত হওয়া, ১৯৮৬ সালে ফেস্টিভ্যাল করা। আদম সুরত নিয়ে প্রায় সাত বছরের যাত্রা, তারপর তার মুক্তির গান (১৯৯৬), তারপর মাটির ময়না (২০০২)। এই যে একটা মানুষের সময় পার হচ্ছে, এটা নির্মাতা হওয়ার প্রক্রিয়াগত জায়গা। উপায় কিন্তু দুইটার সম্মেলন, একটা পদ্ধতিগত আরেকটা গুরুমুখি।  প্রক্রিয়াগত বিষয়ের মধ্যে যে বিচরণ এবং সেটার ঘঁষা-মাজা করে ট্রিম করে একটা গাছ তার আকার ধারণ করেন, গুরু তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই জায়গায় আমার কাছে মনে হয় যে ২০০২–১১ সাল পর্যন্ত তারেক ভাইকে সোজাসুজি বোঝার চেষ্টা করছি। তার চলচ্চিত্র ভাবনা, তার ফিলসফি, এসব বোঝার জানার চেষ্টা করছি। এবং সব সময় নিজেরটা দিয়ে সেটা কন্ট্রাডিক্ট করার চেষ্টা করছি, প্রশ্ন করছি, বিতর্ক করছি। এখন বিষয় হল, সেই যে লিগেসি’র জায়গা যেমন জহির রায়হান থেকে আলমগীর কবির আবার সেখান থেকে তারেক মাসুদ… আমার মনে নতুন প্রজন্ম এই বিশাল জায়গাটা মিস করছে।

কমল: বাবু একটা কথা বলে, সেটা হল আমরা হলাম এখন ডাউনলোড জেনারেশন…

কামার: আমি নেগেটিভ কথা বলতে চাই নি তবু আপনি প্রসঙ্গটা তুললেন… কাজের কথা হল আপনার চলচ্চিত্র ভাবনা, আপনার ফিলসফির জায়গাটা… সেটা তো খুলতে হবে, দরজাটা তো খুলতে হবে। আমার মনে হয় এখনকার তরুণ প্রজন্ম এই জায়গাটা ভীষন মিস করছে। এখন একজন তরুণ কি করে, একটা ক্যানন ফাইভ ডি ক্যামেরা আর ম্যাকবুক নেয়, তারপর শুট শুরু করে দেয়। এটা হল গিটার এ একটা কর্ড বাজানোর মতো, সম্মানের সাথেই বলি। একটা গিটারে কর্ড উঠানো আর একজন মিউজিক কম্পোজার হওয়া এক বিষয় না। দুইটা আলাদা ব্যাপার। আপনার ম্যাকবুক আর আপনার ফাইভ ডি মার্ক টু আপনারে ফিল্মম্যাকার বানাবে না।  আপনি একটা গিটারে একটা কর্ড উঠাতে পারেন। খুব ভালো, কিন্তু আপনি যদি ওই ক্লাসিক্যাল প্রক্রিয়ায় আপনি নর্থ ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল, নজরুলগীতির কথা বলেন, বাক এর মিউজিক এর কথা বলেন, ওই জায়গার মধ্য দিয়ে আপনি যত আলোড়িত হবেন- তত আপনার শিল্পবোধ, শিল্পের প্রকাশ, আপনার সৃষ্টি সেগুলো কিন্তু তত বেশি চ্যালেঞ্জড হবে, দর্শকের ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু আপনি একজন নির্মাতা হিসেবে সারাক্ষণ খেলতে পারবেন। সেই খেলা এবং মজা দুইটাই মিস হয়ে যাচ্ছে। হয় খুব বেশি এক্সপেরিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে ডিসকানেক্টশন এর কারনে। নতুন প্রজন্মের লোকেরা আলমগীর কবির সম্পর্কে জানেই না। অথচ আলমগীর কবিরের সিনেমা ‘সূর্যকন্যা’, বা জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’ বা তারেক মাসুদের ‘অর্ন্তযাত্রা’… এগুলোর মধ্যে যে মজা আছে আপনি কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় দেখতে পারবেন না। সূর্যকন্যায় ১৯৭৫ সালে বানানো যে অপটিক্যাল এনিমেশন আছে সেটা ভাবাই যায় না, নির্মাতা কতটা মডার্ন ছিলেন।

বাবু: নারীর ক্ষমতায়নের যে জায়গাটা? 

কামার: নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারটাকে কিন্তু একটু লাউডলি দেখা হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে উনি নারীবাদি ছিলেন… ওসব কিছু না, আরে ভাই সহজ কথায় উনি মানবতাবাদি নির্মাতা ছিলেন। উনি একটা ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন তুলছিলেন… যে সমাজের পত্তন হইছিল মাতৃতান্ত্রিক হিসাবে সেটা পিতৃতান্ত্রিক কিভাবে হইলো! কিন্তু এখন আমরা কিভাবে ইম্বেল্যান্সড হয়ে গেছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার… একটা চরিত্রের সঙ্কট থেকে তার মগজের ভিতরে প্রবেশ করে একটা এনিমেশন করে একটা হিস্টরি দেখাইয়া দিছেন, দেখলে মনে হয় এখনকার ছবি। একটা জায়গায় ক্যামেরার অস্থিরতা, এখন আমরা ক্যামেরার ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে কত কথা বলা হয়। হ্যান্ডহ্যাল্ড ক্যামেরা কাকে বলে, ১৯৭৫ সালে কেউ জানতো? উনি গল্পের প্রয়োজনে হ্যান্ডহ্যাল্ড ক্যামেরা ব্যাবহার করছে সেই ‘৭৫ সালে। সেই সময় ৩৫মি.লি. ক্যামেরার ওজন ছিল প্রায় ৪০ কেজি। সেইটা নিয়ে দৌড়াইছে। আপনি সেই শটটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। কত রকম এক্সপেরিম্যান্ট করছেন। এখনও আমি অবাক হয়ে যাই ‘কখনো আসেনি’ সিনেমা দেখলে। এই ফিল্মটাতে কতগুলো ক্যামেরার কাজ আছে। কতগুলো কনসেপ্ট এর যায়গা আছে। আমার ফাইভ ডি, কিংবা ম্যাকবুক আমারে এই ল্যাঙ্গুয়েজ শিখাবে না। টেকনোলজি আপনাকে টেকনিক শিখাবে, যেটা চলচ্চিত্র নির্মাণে অপরিহার্য। কিন্তু যে সিনেমাটা আপনি বানাবেন সেই ভাষাটাতো আপনার প্রথমে শিখতে হবে। আপনি বাম আন্দোলন করেন, আর ডান আন্দোলনই করেন, আপনাকে একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাইতে হবে… মানুষ হইতে হবে তো প্রথমে।

কমল: এখন ছবি মুক্তি দেওয়ার বিষয় ছাড়া আর কি নিয়ে কাজ করছেন?

কামার: আমি এইমুহূর্তে একটা ফিচারের স্ক্রিপ্ট লেখা আর দুইটা ডকুমেন্টারি’র রিসার্চ ডেভেলপম্যান্ট লেভেলে আছি। এই তিনটা ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। কিন্তু এই ছবি মুক্তির বিষয়টা ঠিক হওয়ার পর থেকে বাকি সব বন্ধ করে এইটা নিয়েই আছি। অন্য কিছু করা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না।

কমল: আমাদের বাংলাদেশের ফিল্মে সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রির যে অবস্থা অর্থাৎ এফডিসির ছবি, বাইরের ছবি, বা বড় প্রোডাকশন হাউজের ফিল্ম এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম আবার এফডিসির বাইরের ফিল্ম হলেই সেটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট হচ্ছে নাকারন এখানে কিছু বড় বড় প্রডিউসারদের ফিল্ম আছেযদিও আপনারটা একটা ইন্ডিপ্যান্ডেন্ট ফিল্মএখন বাংলাদেশের ফিল্ম এর বতর্মান অবস্থা এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার কি অভিমত কি?

কামার: আমি দুঃখিত কারণ এইখানে আমি পজেটিভ কথা বলতে পারব না। কিছু নেগেটিভ কথা বলতেই হবে। আমি প্রতিদিন খুব ভয়ঙ্কর একটা আশঙ্কা নিয়ে ঘুমাতে যাই যে আগামি দুই- চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশের পুরো চলচ্চিত্র বাজারটা সিনেমা হলসহ বিদেশীদের দখলে চলে যাবে। এইটা অনেকখানি গেছে, ডাউনলোড বা পাইরেটেড এর মাধ্যমে আমার দর্শক অলরেডি বিদেশী সিনেমার ভোক্তা হয়ে গেছে। এর জন্য আমাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত বিভিন্ন মিডিয়াকে। যারা আমাদের মধ্যে ইনজেক্ট করছে ক্যাটরিনা কাইফ থেকে শুরু করে এঞ্জেলিনা জোলি সবাইকে। কে কোথায় বিয়ে করে, কে আংটি পরে, কে তার বাচ্চার নাম কি রাখছে। এসব দ্বারা ইনজেক্ট হয়েই এখনকার তরুন প্রজন্ম দিন যাপন করে। সিনেমাহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম পায়তারা বিভিন্ন রকম আওয়াজ পাই যেটা আমাকে বলে যে আগামি ২/৪ বছরের মধ্যে পুরো ব্যাপারটাই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টা দুইভাবে ঘটতে পারে। একটা হল আপনি সরাসরি বিদেশের ছবি এনে চালাইয়া দিলেন আর অন্য একটা হল আপনি বিদেশি ছবির রিমেইক চালানো শুরু করলেন। দুইটাই কিন্তু দেউলিয়া হওয়া এবং দ্বিতীয়টা কিন্তু অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, এবং একটা কম্পিটিশন চলতেছে কে কার চেয়ে বেশি দেউলিয়া ছবি বানাইতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই যখন এইটা ফেল করে যাবে তখন সরাসরি বিদেশি ছবি প্রবেশ করবে। যখনই রিমেকটা পুরো ফেল করবে তখনই সরাসরি বিদেশি ছবি চলতে শুরু করবে। এখন যেই দাবাং সিনেমা এখানের হলে রিমেক টা চলতেছে পরে দেখবেন মূল দাবাং এখানে চলতেছে। এইটা একটা বিরাট সঙ্কট মনে হয় আমার কাছে। তবে আমি আরেকটা দিকে খুব আশাবাদী এই কারনে যে এখন তরুণ দর্শক এবং তরণ নির্মাতা, তরুণ চলচ্চিত্র কর্মী এবং সরকার মহোদয় সবার যদি একটা সদিচ্ছা থাকে, তাইলে যদি প্রোপার ফিল্ম পলিসি করা যায়। তাইলে আমরা পুরো বিষয়টা আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারি। বিদেশি সিনেমা থামানোর দরকার নেই, আমি বিদেশি সিনেমা থামানোর পক্ষে না, আমি একটা সঠিক রেগুলেশন এর পক্ষে। যার মাধ্যমে আমার ঘরে বৃষ্টি আসলে আমি জানালাটা বন্ধ করে দিতে পারি। এই ব্যবস্থাটা থাকলেই চলবে। এখন আমরা পুরো সিনেমার বাজার উজাড় করে দিয়ে বসে আছি। সেইটা যেন না ঘটে, যা আমাদের টিভি এর ক্ষেত্রে হইছে। এইটা কিন্তু সম্পূর্ণ আমাদের দোষে হইছে, এখন আমরা বলি আমাদের চ্যানেল দেখায় না, শুধু ওদের চ্যানেল দেখায়। এটা ডিস্ট্রিবিউটরদের ব্যর্থতা। সবাই বলতেছে দর্শক কেন বিদেশি চ্যানেল দেখে? এই বিষয়টা এখন চলচ্চিত্রেও ঘটবে। কিন্তু তরুণ দর্শক এবং তরুণ নির্মাতা, তরুণ চলচ্চিত্র কর্মী এবং সরকার মহোদয়ের যদি সদিচ্ছা থাকে তবে পুরো ব্যাপারটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য পসেটিভ টার্ন নিতে পারে।

কমল: আপনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে একজন আর্কিটেক্ট কিন্তু এখন আপনি একজন ফিল্মম্যাকারযদি এর মধ্যে কোনটাই না হতেন তবে কি হইতেন?

কামার: আমি তো এতক্ষন ধরে এইটা ভালো আলাপ আলোচনা ভাবছিলাম। কিন্তু এখনটা আপনি কসমেটিক আলোচনার দিকে চলে গেলেন! হা হা হা আমাকে যদি সুযোগ দেওয়া হত তবে আমি বাঁশি বাজাইতাম। আমাকে যদি ঈশ্বর একটা সুযোগ দিয়ে বলে যে, তুমি কি হইতে চাও? আমি বলতাম, ‘আমি ক্ল্যাসিক্যাল ফ্লুট বাজাইতে চাই… শুধুই নিজের জন্য।’ মাঝে মাঝে যেসব কিছু বাজনা শুনি, মনে হয় যেন আমারই কান্না কেউ বাজাইতাছে। গত কয়েকদিন দিন ধরে একটা পিস (রুদ্রবিনা) প্রতিদিন সকালে তিন চারবার শুনতেছি। এত সুন্দর বাজাইছে বাহাউদ্দিন ডাগর, মনটা অনেক খারাপ হচ্ছে।

কমল : অনেক কথা হল আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

কামার : আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

শুনতে কি পাও: আমার সিনেমা দর্শন/ইলিয়াস কমল

শুনতে কি পাও

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালো’র কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি “শুনতে কি পাও” এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি ‘শুনতে কি পাও’ এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসব ‘সিনেমা দ্যু রিলে’ মূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ ছবি’রপুরষ্কার ‘গ্রা প্রী’ পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। ক’দিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে।
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে ‘আম’ পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।
বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের।