সালমান শাহ: যে বাঁশি ভেঙে গেছে/ হাসনাত শোয়েব

 

‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে তারে কেন গাইতে বল?

কেন আর মিছেই তারে সুরের খেয়া বাইতে বল?’

১৯৯৬ সালে আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। সে বয়সের স্মৃতি মনে থাকাটা স্বাভাবিক না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার তেমন কিছু মনে নেই। শুধু ঝাপসা ঝাপসাভাবে দুটি ঘটনা কেবল মনে করতে পারি। এক শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জয়। আর দুই সালমান শাহ’র মৃত্যু। অর্থ্যৎ ক্রিকেট বিশ্বে নতুন তারকার উত্থান এবং বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নক্ষত্রের পতন।

salman-edit Cover 01

সালমান শাহর মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের শিল্পের জন্য কতটা ভয়াবহ ছিলো তা সালমানের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দিকে চোখ ফেরালেই বুঝা যাবে। সালমানের মৃত্যু চলচ্চিত্র শিল্পে অদ্ভুত এক স্থবিরতা এনে দিয়েছিলো। যেনো কারো কিছু করার নেই। সালমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ওমর সানীও কোন এক অজানা কারণে সিনেমা থেকে দূরে সরে গেলেন। ফেরদৌস-রিয়াজরা এসে সেই হাল ধরার চেষ্টা করলেও ততদিনে দর্শকও কেমন জানি ম্যানিয়াক হয়ে গেলো। তারপর চলচ্চিত্রকে চালানোর জন্য কাটপিসের আমদানি করতে হলো। এক শ্রেণির দর্শক তাতে সাড়া দিলেও মধ্যবিত্ত দর্শকের বৃহত্তর অংশ হা-পিত্যেস করতে করতে বাংলা সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো। ঐ সময় একমাত্র মান্নাই মূলত নিম্নবর্গীয় দর্শককে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। যা ক্রমান্বয়ে তাদের মাঝে মান্নাকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিলো। মান্নার মৃত্যুর পর তার জানাজায় মানুষের ঢলই বলে দিয়েছিলো তাদের কতটা কাছে ছিলেন তিনি। কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে সিনেমাকে নিয়ে যাওয়ার অথবা দর্শককে সিনেমার কাছে নিয়ে আসার কোন কাজই সিনেমার কুশীলবরা তখন করতে পারেন নি।

মূলত আশির শেষ এবং নব্বই শুরু থেকেই বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায়ীক দিক থেকে তুঙ্গে অবস্থান করছিলো। ঐ সময়ের চলচ্চিত্রের অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাতকারে সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী বলছেন, দর্শক সে সময় মূলত চারভাগে বিভক্ত ছিলো। এক ভাগে ছিলো রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনরা, দ্বিতীয় ভাগে ছিলো রুবেল, তৃতীয় ভাগে ছিলো শাবানা। আর অন্য ভাগে ছিলাম আমি (ওমর সানী) আর সালমান।

ওমর সানীর এই কথা ধরে বলা যায় ঐ সময় বেশিরভাগ নায়ক-নায়িকারা নিজেদের জন্য দর্শক শ্রেণী তৈরি করতে পেরেছিলো। যা সে সময় সব শ্রেণীর দর্শককে হলে নিয়ে আসতে পেরেছিলো। তাই ব্যবসায়ীক দিক থেকেও চলচ্চিত্রগুলো সফলতা পেয়েছিলো।

কিন্তু এসব কিছুর পরেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে সালমানের আগমন একটা টার্নিং পয়েন্ট বটে। সালমান মূলত গতানুগতিক ধারাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। সালমান মোট অভিনয় করেছেন ২৭ টি ছবিতে। যার মধ্যে মাত্র তিন কি চারটি ছবি ব্যাবসায়ীকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো। এমন কোন এক্সপেরিমেন্টাল ছবিতে অভিনয় করেন নি তিনি। সবই ছিলো সামাজিক ঘটনা নির্ভর ছবি। প্রেম-সামাজিক অবক্ষয়- গুড ভার্সেস এভিলের লড়াই, ধনী-গরীব বৈষম্য এবং অবশেষে হ্যাপি এন্ডিং। এসব ডিসকোর্সের মধ্যেই সিনেমার মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছিলো। তবে তখনকার নায়করা সিনেমার শেষে মরতে না চাইলেও সালমান বেশ কয়েকটি ছবিতে মরার সাহস করেছিলেন। তিনি তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ এ মৃত্যুর দৃশ্যে অভিনয় করার সাহস দেখিয়েছিলেন। শুধু সালমান না, ঐ সিনেমার নায়িকা মৌসুমীও মরেছিলেন তার সাথে।

সালমান নিয়ে বলতে গিয়ে সানীর ভাষ্য, ওই সময়ে সালমান ছিলো স্টার। কিন্তু মৃত্যুর পর দর্শক তাকে সুপারস্টার বানিয়েছে। অর্থ্যাৎ সানীর কথা যদি সত্য ধরে নেই তবে মৃত্যু সালমানের জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়িয়েছে, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা সে হারেই কমিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো একটি স্টেরিওটাইপ ধারার মধ্যে সালমান এমন কী করেছিলেন যা তাকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো? সালমান প্রথমত নিজেকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তিনি হয়তো আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম স্টাইল আইকন। কখনো পনিটেল, কখনো কাউবয় হ্যাট আবার কখনো অভিনব গগলস। পোশাকেও নতুনত্ব এনেছিলেন সালমান। এসবই তাকে মধ্যবিত্ত বাঙালি তরুণদের কাছে আইডল এবং তরুণীদের কাছে স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো। যাদের কেউ কেউ সালমানের মৃত্যুর পর আত্মঘাতী হয়েছিলো। আর যারা বেঁচে ছিলেন তারা এক রহস্যময় অভিমান নিয়ে সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো।

Poster Compile

সালমান মূলত মধ্যবিত্তের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেই চরিত্র, যাকে মধ্যবিত্ত তাদের আপন ভাবতে পেরেছিলো। অনেক দূরের হয়েও যিনি ছিলেন খুব কাছের। বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফির জনপ্রিয়তাকে হয়তো সালমানের জনপ্রিয়তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যারা সুপারস্টার হওয়ার পরও মধ্যবিত্তের কাতারে শামিল হয়েছেন অতি সাধারণ একজন কাছের মানুষের মতো । এখানে অন্যান্য তারকাদের চেয়ে এক ধাক্কায় আলাদা হয়ে যান তারা।

অভিনয়েও সালমান ছিলেন সাবলীল। যেকোন ধরনের চরিত্রের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অসামান্য এক গুণ ছিলো তার। তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখে কেউ বলবে না এটা তার প্রথম ছবি। মনে রাখা দরকার এই একই চরিত্রে অভিনয় করে অভিষেক হয়েছিলো বলিউড সুপারস্টার আমির খানেরও। কিন্তু দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলে বলা যেতে পারে তর্কযোগ্যভাবে সালমানের অভিনয় আমিরের চেয়ে ভালো ছিলো। এছাড়া ‘বিক্ষোভ’এর দেশপ্রেমিক যুবক, ‘আনন্দ অশ্রু’র পাগল খসরু, ‘মায়ের অধিকার’র রাগী যুবক অথবা ‘তোমাকে চাই’র প্রেমিক যুবক। সব চরিত্রেই সহজাত অভিনয় করে দেখিয়েছেন সালমান।

তবে তার সময়ের বা তারও আগের অন্য নায়কদের চেয়ে সালমানের পার্থক্য হলো সালমান সচেতন বা অবচেতনে ‘মেলোড্রামা

‘কে নিজের অভিনয় থেকে বাদ দিতে পেরেছিলেন। অথচ একই ধরনের কাহিনীর মধ্যেই অন্যরা বেশিরভাগ সময় তাল রাখতে পারেন নি। সালমানের আগে এই কাজটি সম্ভবত রাজ্জাক এবং কিছুটা পেরেছিলেন আলমগীর।

আগেই বলেছি সালমানের সিনেমা ‘আলাদা’ কিছু  বলে নাই। ওই সময়ের আর দশটা জনপ্রিয় ধারার সিনেমার মতোই সালমানের ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সালমানের বয়ান ভঙ্গিমা ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। পরিমিতিবোধ, প্রেজেন্টেশন, স্টাইল এবং সালমানের স্বকীয়তা সেইসব সিনেমাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সালমান ছিলেন অভিনেতা। যেটুকু চরিত্র পেয়েছেন সেখানে নিজের রঙ ঢেলে দিয়েছেন। আজ যখন মেইনস্ট্রিম সিনেমার বাইরে গিয়ে অনেক নির্মাতা কাজ করছেন তখনই সালমানের অভাব আরো বেশি বেশি অনুভব হচ্ছে। পশ্চিম বাংলার নায়ক প্রসেনজিতের দিকে তাকালেই তা বুঝা যায়। এক সময়ের বানিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় এই নায়ক মেইনস্ট্রিমের বাইরে গিয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সালমানও নিঃসন্দেহে সে জায়গায় পৌছতে পারতেন অনায়সে। কিন্তু মৃত্যু সেসব সম্ভাবনার গায়ে নোকতা বসিয়ে দিয়েছে।

শুধু চলচ্চিত্রে না, বাংলা নাটকেও সালমান তার স্বকীয়তা দেখিয়েছেন। অভিনয় জীবনে মোট ৮ টি নাটকে অভিনয় করেছেন সালমান। এর মধ্যে ‘নয়ন’ তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের যখন তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি নয়নে অভিনয় করেন। এই নাটকে একজন মাস্তানের ভূমিকায় অভিনয় করে সফল সালমান। অথচ যে সময়ে তিনি নাটকটি করেন অন্য কেউ হলে এরকম চরিত্রে অভিনয় করার সাহস করতেন না। একটু উনিশ-বিশ হলে যা তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলতে পারতো। কিন্তু নাটকটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ‘নয়ন’ সে বছর বাচচাস এর শ্রেষ্ঠ নাটকের পুরস্কার পেয়েছিলো। সালমান মূলত যেখানেই হাত দিয়েছিলেন সেখানেই সফল হয়েছিলেন।

সালমান পরবর্তী সময়ে অনেকেই সালমানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সালমান কেবলই সালমান। হয়তো আধুনিক বাংলা সিনেমার অন্যতম মায়েস্ত্রো। যার অকাল মৃত্যু এক ঘোর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিলা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতকে। অনেকদিন পর এসে অনেকেই চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সিনেমাকে তার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ততদিনে পানি গড়িয়ে গেছে অনেকদূর। একের পর এক হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।  এর  মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত দর্শকরা। মধ্যবিত্তের ঘুম বরাবরই রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো। সে ঘুম সহজে ভাঙে না। তবে সরওয়ার ফারুকী কিংবা তারেক মাসুদদের লড়াই বাংলাদেশের সিনেমাকে নতুন মোড় দিয়েছে। আবার অন্যদিকে শাকিব বা অনন্তরা সংকটকালীন সময়ে চলচ্চিত্রকেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্তের একটা নগন্য অংশ ইতোমধ্যে হলে ফিরতে শুরু করেছে। তবে আগের সেই ‘গণজোয়ার’ এখনো বহদূর। দিল্লি এখনো তাই দূর অস্তই বটে। তবে একদিন হয়তো দিন ফিরবে। যেদিন সকলে এক কাতারে হলের দিকে মুখ ফেরাবে। কিন্তু কে জানে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর না আসলে, আজ হয়তো সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকতে হতো না।