বলাই বাহুল্য যে একটি চলচ্চিত্র প্রথমত ও প্রধানত এর নির্মাতাকে প্রতিনিধিত্ব করে; নির্মাতার দর্শণ, সৃজনশীলতা, বিশ্বাস, মনস্তত্ত্ব, রুচিবোধ, অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয় চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি অনুষঙ্গে। এই সূত্র অনুসরণ করে শুধু ‘আহা!’ দেখে কোনও অনুসন্ধিৎসু দর্শক যদি এর পরিচালক সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি বেশ কিছু দিক খুঁজে পেতে পারেন। সেগুলো নিয়েই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।
১.
স্থাপত্যশিল্পের প্রতি পরিচালকের নিদারুণ অনুরক্তি খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্রই হচ্ছে একটি ক্ষীয়মান পুরানো দালান। যা ভেঙ্গে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের পায়তাড়া চলছে। এছাড়া পরিচালক প্রাসঙ্গিকভাবেই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অংশে ঢাকার বিশেষ কিছু স্থাপত্যকীর্তি প্রদর্শন করেছেন। যেমনঃ রুবা (সাথী ইয়াসমীন) যখন বাংলাদেশে এসে বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ক্যাব করে নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তখন তার Point of View (POV) থেকে নভোথিয়েটার, জাতীয় সংসদ ভবন দেখানো হয়। আবার রুবা যখন কিসলুর (হুমায়ুন ফরিদী) সঙ্গে দেখা করে তখন তাদেরকে লালবাগের কেল্লায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পরিচালক বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশিল্প উপস্থাপন করেছেন এই চলচ্চিত্রে।
২.
পরিচালক ভীষণ রকম গোছানো, ফোকাসড, মিনিমালিস্ট। বিশাল ক্যানভাসে বিক্ষিপ্ত অজস্র ঘটনার সম্মিলন না ঘটিয়ে খুব সীমিত কলেবরে, অল্প সংখ্যক চরিত্রের মাধ্যমে ‘আহা!’র গল্প বলেছেন। এটা করতে গিয়ে আবার কোনরকম একঘেয়েমি তৈরী হয় নি। বরং ১২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই দর্শকের মনোযোগ ও আগ্রহ অটুটভাবে ধরে রাখতে সক্ষম। পরিচালক আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা একটা গল্প বা বিষয়বস্তু নির্বাচন করে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবার জন্য প্রতিটি বিভাগের ব্যপ্তি সীমিত রাখবার চেষ্টা করেছেন। উদাহারণস্বরুপ উল্লেখ করা যায় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত লোকেশনের প্রসঙ্গ। এই চলচ্চিত্রটির সিংহভাগ দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে শুধুমাত্র মল্লিক সাহেবের (তারিক আনাম) বাড়িতে; এই বাড়ির বারান্দা, বিভিন্ন ঘর আর উঠানেই চলচ্চিত্রটির প্রায় ৮০ শতাংশ দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। মূলতঃ স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুপরিকল্পিতভাবে দৃশ্যধারণ করবার জন্যই এ চলচ্চিত্রে অল্প সংখ্যক লোকেশন ব্যবহার করা হয়েছে।
৩.
সংগীতের প্রতি পরিচালকের অনুরক্তিও এই চলচ্চিত্রে লক্ষ্যণীয়। ‘আহা’র সংগীতায়োজন করেছেন দ্যেবজ্যেতি মিশ্র, যিনি এই চলচ্চিত্রের জন্য ৬টি মৌলিক গান সুর করেছেন এবং প্রতিটি গানের কথা লিখেছেন পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর নিজেই। গতানুগতিক অন্যান্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মত গানগুলোতে অভিনয়শিল্পীদের ঠোট মেলাতে (Lip Sync) বা নাচতে দেখা যায় না, বরং গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গানগুলোকে বিভিন্ন অংশে নেপথ্য সংগীত হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রগুলোর বিষাদ ও বিষন্নতা এই গানগুলোতেও সার্থকভাবে অনুরণিত হয়েছে যা এই চলচ্চিত্রের মূলভাবকে আরো পরিণত ও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে।
‘আহা!’ এক অর্থে কিছু নিঃসঙ্গ মানুষের একাকীত্বের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টার গল্প। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নির্বান্ধব, যারা নানাভাবে নিজেদের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর রুবা বাংলাদেশে এসে একাকী জীবন কাটাতে শুরু করে, তার কোন পুরানো বন্ধুবান্ধবকেও এখানে দেখা যায় না। এক পর্যায়ে পাশের বাড়ীর কিসলু নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে তার সখ্যতা তৈরী হয়, যিনি নিজেও একটি ফ্ল্যাটে একাকী জীবনযাপন করেন। রুবার বাবা মল্লিক সাহেব বিপত্নীক হয়েছেন বহু আগে ( কথাপ্রসঙ্গে জানা যায় রুবাকে মেট্রিক পরীক্ষার পর তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয় কারণ মা-মরা মেয়েকে দেখাশোনা করবার কেউ ছিল না), যাকে মধ্যরাতে স্ত্রীর পুরানো ঘরে মন খারাপ করে একলা বসে থাকতে দেখা যায়। রুবার মিনা খালারও (প্রজ্ঞা লাবণী) স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক আগে, যিনি রুবাকে নিয়ে এক বিকেলে ছাদে হেটে বেড়াবার সময় তার পোষা কবুতরগুলো দেখিয়ে বলেন “ওরাই তো আমার সংসার। আমার ছেলেমেয়ে, ওরাই তো সব!”
একটি দৃশ্যে কিসলুর বন্ধু খাদেমকে (খালেদ খান) বলতে শোনা যায় “আমি শেয়ার বাজার করি বলে কি কবিতা লিখতে পারব না? আরে যার চরিত্রে যত বেশী contrast, তার চরিত্রই তো তত বেশী interesting!” ‘আহা!’র প্রতিটি চরিত্রেই ভীষণ রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। খাদেম তার বন্ধুকে ‘ভেঁদামাছ’ বলে গালি দিলেও কিন্তু কিসলুকে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবসময় পরিপাটি করে আচড়ানো চুল এবং ভারী চশমা আর সাদামাটা পোশাক পড়া কিসলুকে দেখে খুব শান্ত, নিরীহ, গোবেচারা ধরণের মানুষ মনে হলেও, তাকে একসময় হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে দেখা যায়। সে যখন রুবাকে নিয়ে বুড়ীগঙ্গা সেতুতে ঘুরতে যায় তখন নদীর নোংড়া, দূষিত পানি দেখে চিৎকার করে বলে “ওই মানুষ! তোরা এত অসভ্য কেন? নিজেরা যেই নদীটাকে ব্যবহার করিস আবার সেই পানিই নষ্ট করে ফেলেছিস! তোদের লজ্জা করে না?” আবার কিসলুকে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রঙের আন্ডারগার্মেন্টস নিজের বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখা গেলেও তাকে সবসময় সাদা পাঞ্জাবী আর প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখা যায়। পোশাকের এরকম পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালক মূলতঃ কিসলু চরিত্রের বোকাটে বেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রগাড় প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বকেই ইঙ্গিত করেছেন।
এরকম ‘স্ববিরোধতা’ অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝেও দৃশ্যমান। যেমন মল্লিক সাহেবকে এখানে একজন নীতিবান, পরহেজগার মানুষ হিসাবে দেখানো হয়, আবার এই মল্লিক সাহেবই সোলেমান নামের এক স্বঘোষিত খুনীকে নিজের বাড়ীর দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ দেন, এমনকি চলচ্চিত্রের শেষ অংশে কিসলুকে হত্যা করবার নির্দেশও দেন যা তার মহনীয় ব্যক্তিত্বের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। আবার এই সোলেমানকে ক্রিকেট খেলার ভীষণ ভক্ত হিসাবে দেখা যায়, বাড়ীর কাজের ছেলে রতনের সাথে দেখা হলেই সে তাকে বাংলাদশের খেলার স্কোর জিজ্ঞাসা করে। রতন একসময় বিরক্ত হয়ে বলে ‘প্রতিদিনই কি বাংলাদেশের খেলা থাকে?’ কিন্তু এই সোলেমানই আবার পাড়ার ছেলেদের বাড়ীর সামনে ক্রিকেট খেলা মোটেও পছন্দ করে না এবং একবার ক্রিকেটের বল নিতে একটি ছেলে বাড়ীতে ঢুকলে তাকে বেধড়ক পেটায়। এরকমভাবে প্রতিটি চরিত্রের আচরণে নানারকম অসঙ্গতি দেখা যায় যা প্রকৃতঅর্থেই চরিত্রগুলোকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে।
শুধু চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বই নয়, বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে ব্যক্তিত্বের সংঘাতও এই চলচ্চিত্রে বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহারণস্বরুপ আসিফ (ফেরদৌস) ও কিসলু চরিত্র দু’টির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আসিফ একদিকে বেশ কেতাদুরস্ত, চঞ্চল, আধুনিক আর কিসলু কিছুটা রাশভারী, সাদাসিধা ও সেকেলে। তারা যখন রুবার ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে মিলিত হয় তখন তাদের নিজেদের পরিচয় দেবার পর্বটি বেশ কৌতুকাবহ। আসিফ নিজের সম্পর্কে বলে “আমি business করছি… মানে চেষ্টা করছি, Trying to do something.”, প্রত্যুত্তরে অপরজন বলে “আমি কিসলু, কিসলু হাসান, কিছু না করার চেষ্টা করছি।”
এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রের কথা বলার ধরণের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন রফিক সাহেব (শহিদুল আলম সাচ্চু) চাপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা এবং স্বভাবতই তার কথায় রাজশাহীর টান লক্ষ্য করা যায়। মল্লিক সাহেবের পাড়ার ছেলেরা পুরান ঢাকাবাসীর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে কথা বলে, আবার রুনা খালা কথা বলেন পুরোপুরি প্রমিত বাংলায়। আসিফ আর রুবাকে প্রচুর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের কথা বলার ধরণ একটু খটকা তৈরী করে কারণ তিনি পুরান ঢাকাতে জন্মগ্রহণ করেছেন ও প্রতিপালিত হয়েছেন কিন্তু কথা বলা বলেন শুদ্ধ বাংলায়।
মল্লিক সাহেবের ভঙ্গুরপ্রায় বাড়ীর জায়গায় নতুন দালান বানাবার প্রলোভন দেখাচ্ছে ‘Dream Properties’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান আর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসাবে দেখা যায় রফিক নামের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে যার উপস্থিতি যথাসম্ভব অপ্রীতিকরভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। গাড়ো কালো বর্ণের বেঢপ আকৃতির রফিক সাহেবকে ধূসর বর্ণের পোশাক, সোনালী ফ্রেমের চশমায় বেশ বিচিত্র লাগে, আর কথা বলার সময় অশালীন শব্দের ব্যবহার, অপরিশীলিত কার্যকলাপের মাধ্যমে (যেমনঃ কাপে ঢেলে শব্দ করে চুমুক দিয়ে চা খাওয়া, তোতলামি করা, বাতকর্ম করা) তাকে আরো বিরক্তিকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলতঃ মুনাফালোভী রিয়েল এস্টেট ডেভলপারদের অশুভ তৎপরতার প্রতি পরিচালকের বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে রফিক চরিত্রের মাধ্যমে। রফিক সাহেব সময়ে-অসময়ে মল্লিক সাহেবকে এসে বাড়ী ভাঙ্গার দলিলে স্বাক্ষর করবার জন্য তাগাদা দিয়ে বিরক্ত করেন, কিন্তু স্থাপত্যবিদ্যার কিছু শিক্ষার্থী যখন বাড়ীটির ছবি তুলবার জন্য ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চায়, তখন সোলেমান তাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেয় না। বর্তমান সমাজে ধূর্ত স্বার্থানেষী মানুষেরা যে খুব সহজেই নিজেদের সুযোগ তৈরী করে নেয় আর মননশীল লোকেরা নির্বিঘ্নে তাদের সুকুমার বৃত্তির পরিচর্যা করতে পারে না ,এই ঘটনা মাধ্যমে সেই বৈষম্যের দিকেই পরিচালক ইঙ্গিত করেছেন।
‘আহা!’ চলচ্চিত্রের অন্যতম রহস্যময়, জটিল ও মানসিকভাবে উপদ্রুত চরিত্র হচ্ছে সোলেমান এবং এই চরিত্রকে নিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালক কিছু মজার পন্থা অবলম্বন করেছেন। যেমনঃ সোলেমান উপস্থিতি রয়েছে এমন কিছু দৃশ্যের নেপথ্যে মাছির ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শোনা যায় যা এক ধরণের অস্বস্তি তৈরী করে। সোলেমানের স্বপ্নদৃশ্যে কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য (যেমনঃ হাতির ক্লোজ-আপ শট, বাংলা ছবির নায়িকার চেহারা) প্রদর্শন করে তার ভীতি, অবদমিত কামনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। পাড়ার ছেলদের সাথে আগ বাড়িয়ে বিবাদে জড়ানো, বুবার (রুবার ছেলে) খৎনার অনুষ্ঠানে আয়োজিত মুরগি লড়াইয়ের সময় তার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়া, বাড়ীর ছবি তুলতে আসা ছেলেদের সাথে অনর্থক দুর্ব্যবহার করা ইত্যাদি তার হিংস্রস্বত্তারই পরিচয় বহন করে।
চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত রুবার অবদমিত কামনাকেও পরিচালক একটি রূপক দৃশ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এই দৃশ্যটিতে কোন সংলাপ নেই, শুধু নেপথ্যে দ্রুত লয়ের একটি সংগীত শোনা যায়, যেখানে সমস্বরে কিছু পুরুষ বারংবার ‘আহা’ বলতে থাকে। এ দৃশ্যে ভারী বৃষ্টির মাঝে একদল ছেলেকে খালি গায়ে রুবাদের বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তারা মাঠে একটি ফুটবল নিয়ে খেলা শুরু করে, কিন্তু খেলায় কোনরকম শৃঙ্খলা দেখা যায় না। সবাইকে ফুটবলের দখল পেতে মরিয়া দেখা যায়। রুবা ছেলেগুলোকে খেলতে দেখে অবাক হয় না, বরং বাড়ি থেকে বের হয় আসে। বৃষ্টির মধ্যেই তাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায়, যেন সে ছেলেগুলোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে রুবা এবং খেলায় মগ্ন ছেলেগুলোকে কখনো এক ফ্রেমে দেখা যায় না। এ দৃশ্যের শেষ শটে দেখা যায়, রুবা চোখ বুঝে বৃষ্টির মাঝে ওপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ক্যামেরা তাকে ঘিরে ঘুরছে। হঠাৎ ঢাকের বাড়ির মধ্য দিয়ে নেপথ্য সংগীত শেষ হয়, আর রুবা চোখ মেলে ক্যামেরার দিকে তাকায়, যেন এ আওয়াজে সে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্য ও ক্লোজ-মিড-লং শটের সমন্বয়,অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের বিপরীতে রুবার হলুদ শাড়ি, হল্লারত ছেলেদের ফুটবল নিয়ে কাড়াকাড়ি, দ্রুত লয়ের সংগীত সব মিলিয়ে এ দৃশ্যটির মাধ্যমে নিপুনতার সঙ্গে পরিচালক রুবার শমিত বাসনাকে উপস্থাপন করেছেন।
যে গুটিকয়েক বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী তার মধ্যে অন্যতম ‘আহা!’। রুবা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অসহায়ত্ব পরিচালক সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রুবার বিয়ে হয়ে যায় বেশ অল্প বয়সেই, ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করেই এক প্রবাসী ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয় এবং সহজেই বোধগম্য যে বিয়েতে তার মতামত খুব একটা গুরুত্ব পায় নি। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলে বুবাকে নিয়ে রুবা দেশে ফিরে আসে, আশ্রয় নেয় বাবার ঘরে কিন্তু এখানেও সে নানাভাবে নিগৃহীত হতে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে বাবার মতামতের কাছে তাকে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করতে হয়। বুবার মুসলমানীর অনুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণভাবে করতে রাজী না থাকলেও বাবার গোয়ার্তুমির কাছে সে হার স্বীকার করে, বারংবার বাবাকে বাড়ী ভাঙ্গার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়, সোলেমানকে বিদায় করবার জন্য অনুরোধ করেও বাবাকে রাজী করাতে পারে না। রুবাকে অনেকবারই জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যা তার বন্দী দশাকেই রুপকঅর্থে ফুটিয়ে তোলে। মার্জিত, শিক্ষিত খালাতো ভাই আসিফও যখন অন্যায়ভাবে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করে তখন সে তার প্রতিবাদ করলেও রাতের আধারে তাকে অঝরে কাঁদতে দেখা যায়। একমাত্র কিসলুর সঙ্গেই তার একরকম সখ্যতা তৈরী হয়, কিন্তু এখানেও তার বাবা বাধা হয়ে দাড়ান। বাবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে রুবা তাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখার কথা বললে মল্লিক সাহেব কিসলুকে খুন করবার সিদ্ধান্ত নেন। তার মৃত্যুসংবাদ শুনে একবার কিসলুর বাড়ীতে যেতে চাইলেও বাবা তাকে টেনেহেচড়ে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলেন। এভাবে রুবাকে পদে পদে পরাজিত হতে দেখি। অপরদিকে মল্লিক সাহেব অনায়াসেই তার পুরানো দালান ভাঙ্গার অনুমতি দিলেও তার পুরাতন সংস্কারবোধে তিনি কোনরকম আচড় পড়তে দেন না।
সম্পাদনা সম্পর্কে আন্দ্রে তারকাভোস্কি বলেছিলেন যে হলিউডের কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে সেগুলোর সম্পাদনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যাবে এই চলচ্চিত্রগুলোর সম্পাদনা একই ব্যক্তি করেছেন। কিন্তু বার্গম্যান, ব্রেসো, কুরোশোয়া, এন্তোনিয়নিদের মত মেধাবী পরিচালকদের সম্পাদনার কৌশল বা স্টাইল একেকরকম, তাদের প্রত্যেকের সম্পাদনায় স্বকীয়তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে (পৃ-১২১, স্কাল্পটিং ইন টাইম)। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রেও পরিচালক নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আহা’র সম্পাদনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রচুর Cross-cutting (একই সময়ে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা সমান্তরালভাবে দেখানো) এর ব্যবহার যা সচরাচর কোন চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। সাধারণত উদ্বেগ (suspense) তৈরী করবার জন্য Cross-cutting এর ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এই চলচ্চিত্রে এর ব্যবহার করার পেছনে কারণ হিসাবে ধারণা করা যায় চলচ্চিত্রের ঘটনাপ্রবাহে কিছুটা গতি সঞ্চার করা। চলচ্চিত্রের শটগুলোর দৈর্ঘ্য প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছুটা দীর্ঘতর যা চলচ্চিত্রের আবহকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে, কিছু কিছু দৃশ্য একটিমাত্র শটেই ধারণ করা হয়েছে, যেমন পাড়ার ছেলেদের দ্বারা সোলেমানের প্রহৃত হবার দৃশ্য, পাশা ভাইয়ের সাথে পাড়ার ছেলেদের কথোপকথন ইত্যাদি যা পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে।
‘আহা!’ তে প্রচুর High Angle ও Low Angle Shot ব্যবহার করা হয়েছে, যার অনেকগুলোতেই পরিচালক চাইলেই ক্যামেরা Eye Level এ রাখতে পারতেন। নির্মাতা ইচ্ছা করেই এই ব্যতিক্রমী পন্থা অবলম্বন করেছেন যা দর্শককে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে কৌতুহলী ও মনোযোগী রাখতে সমর্থ হয়েছে। যেহেতু চলচ্চিত্রের বেশীর ভাগ অংশের চিত্রধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধ জায়গায় তাই যথোপযুক্তভাবেই এই চলচ্চিত্রে মিড শট ও ক্লোজ শটের প্রাধান্য খুব বেশী যা দর্শকের মনে একধরণের আবদ্ধ বা Claustrophobic অনুভূতি তৈরী করে। এই চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক Long Shot ব্যবহার করা হয়েছে রুবা ও কিসলুর ঘুরে বেড়ানো দৃশ্যে যেখানে তাদের লালাবাগের কেল্লা, বুড়ীগঙ্গার ব্রীজ প্রভৃতি জায়গায় গল্প করে বেড়াতে দেখা যায়। এই দৃশ্যগুলোতে Long Shot এর ব্যবহার করে শুধু সাময়িকভাবে রুবার মুক্ত হবার আনব্দকেই নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলে না এটা দর্শককেও একরকম Breathing Space দেয়।
‘আহা’ চলচ্চিত্রে অনেকজন প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীর সমাগম হয়েছে যাদের অসামান্য অভিনয় এই চলচ্চিত্রটিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। তারেক আনাম খান, হুমায়ুন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু প্রত্যেকেই নিপুনভাবে নিজেদের চরিত্র রুপায়ন করেছেন যা চলচ্চিত্রটির প্রতি তাদের মমতা ও দায়বদ্ধতারই (commitment) পরিচয় বহন করে। বেশীর ভাগ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ ৩/৪ টি চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু অন্যান্য শিল্পীদের দুর্বল অভিনয়ের কারণে অনেক সময় চলচ্চিত্রগুলো ন্যূনতম মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রটি এই দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। এখানে প্রতিটি চরিত্রকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট চরিত্রেগুলোতে শহীদুল আলম সাচ্চু,গাজী রাকায়েত,প্রজ্ঞা লাবনীর মত কুশীলবদের প্রাণবন্ত ও সাবলীল অভিনয় চলচ্চিত্রটিকে বাস্তবিক করে তুলেছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়বে কিসলুর বন্ধুর চরিত্র রুপদানকারী খালেদ খানের অনবদ্য অভিনয়। তার বাচনভঙ্গী, একটু পরপর বিচিত্রভাবে হাত ঝাঁকি দেয়া, চপল (Prankinsh) চাহনি ও কৌতুকময় সংলাপ বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে যা তার খুব সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিকেও তাৎপর্যময় করে তুলেছে।
এই চলচ্চিত্রের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছে সাথী ইয়াসমীন যে কি-না এই চলচ্চিত্রের অন্যান্য শিল্পীদের তুলনায় কিছুটা কম পরিচিত। ‘আহা!’র কলাকুশলীদের এক টেলিভিশন আলাপচারিতায় পরিচালক নির্ঝর কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন যে এ চরিত্রটির করবার জন্য তিনি অনেককেই প্রস্তাব দিয়েছেন যারা কেউই সাড়া না দেয়ায় তিনি কিছুটা হতাশও হয়ে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হুমায়ুন ফরিদী এই প্রসঙ্গে বলেন যে সাধারণত জনপ্রিয় নায়িকারা কোন বাচ্চার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চায় না কারণ তারা মনে করে যে এতে দর্শকদের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা কমে যায়। যেখানে সমসাময়িক অন্যান্য কলাকুশলীদের মাঝে এমন উদ্ভট ও অপেশাদারী মনোভাব কাজ করে, সেখানে পরম মমতায় রুবা চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলবার জন্য সাথী ইয়াসমীন আন্তরিক সাধুবাদের দাবিদার।
ইদানীং খুব হেলাফেলায় চলচ্চিত্র নির্মান করে পরিচালকদের তা নিয়ে অহেতুক বড়াই করতে দেখা যায়, কিন্তু একটি চলচ্চিত্রের সবধরণের দুর্বলতা উপেক্ষা বা ক্ষমা করা গেলেও যা ক্ষমার অযোগ্য তা হচ্ছে চলচ্চিত্রটির প্রতি পরিচালকের উদাসীনতা।কেউ যদি শুধুমাত্র এ ব্যাপারটি মাথায় রেখে ‘আহা!’কে মূল্যায়ন করতে চায় তাহলে হয়ত সে একতরফাভাবে এর ভূয়সী প্রশংসা করে গেলেও অপরাধ করবে না কারণ চলচ্চিত্রটির প্রতিটি বিভাগে নির্মাতার যত্ন,চিন্তা ও পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। এনামুল করিম নির্ঝর সরকারী অনুদানে এরপর আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মান করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা এখনো মুক্তি দিতে পারেন নি। ‘আহা!’ নির্মানের পর গত ৬ বছরে এই পরিচালকের আর কোন নতুন কাজ দেখবার সুযোগ হয় নি! এটা চিন্তা করলে, পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্রটি দেখে বনে যাওয়া ভক্তরা হয়ত নিজের অজান্তেই অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ উচ্চারণ করবেন- ‘আহা!’