গৌতম ঘোষের সরল ছেলেমানুষি ও সীমান্তের শঙ্খচিল/মিতুল আহমেদ

প্রায় তিন বছর পর সিনেমায় হাত দিলেন গৌতম ঘোষ। তাও দুই দেশের যৌথ নির্মাণ!এর আগেও যৌথ উদ্যোগে সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। তবে এবারেরটা ভিন্ন। আগে যে দুটি যৌথ সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা তার আছে তা মূলত ছিলো দুটি তৈরি করা গল্পের অ্যাডাপটেশন! একটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, আর অন্যটা সুনীল গাঙ্গুলীর মনের মানুষ। দুটো ছবি ভারতে কেমন সাড়া ফেলেছিল তা অজানা থাকলেও বাংলাদেশে ছবি দুটো উচ্চ ও বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। ফলে গৌতম ঘোষের ছবি মানেই উচ্চ মহলে, বুদ্ধিজীবী মহলে পর্যাপ্ত গুরুত্বসহ নেয়া হয় এটা একরকম প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর গৌতম ঘোষ নিজেও এমনটি জানেন বলেই হয়তো এবার কোনো ধরনের অ্যাডাপটেশনে না গিয়ে নিজের একটি মৌলিক অথচ ‘উদ্ভট’ ও যুক্তিহীন গল্পের একটা সিনেমা নিয়ে পরম আশাবাদী হয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশে!

gowtom ghosh

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কাঁটাতার বিষয়ক জটিলতার মত স্পর্শকাতর গল্প নিয়ে নির্মিত ‘শঙ্খচিল’ নামের সিনেমাটি বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকদের খাওয়াতে পরম আশাবাদী হয়ে গত ১২ এপ্রিল গৌতম ঘোষ ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে। সেদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎসহ বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকেরা! আর সেখানেই এলিট মানুষের সাথে এলিট একটা ভাব নিয়ে দেখা ফেলা গেল ছবিটি! এবং কাকতালীয়ভাবে নির্মাতা গৌতম ঘোষের পাশে বসেই! না না, এক হল রুমের কথা বলছি না, সত্যি সত্যিই একেবারে পাশাপাশি বসে!ফলে সিনেমায় যে জায়গাগুলোকে তিনি ‘কি পয়েন্ট’ মনে করেছেন, এবং ঘাড় উল্টিয়ে হলভর্তি দর্শকদের দিকে বারবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করেছেন সে বিষয়গুলো বিশেষ নজর কেড়েছে।

সীমান্তে নিহত আলোচিত বাংলাদেশের মেয়ে ফেলানির মত কাঁটাতারে ঝুলে থাকা একটা লাশের দৃশ্যের মাধ্যমে শুরু হয় সিনেমা। তার আগে চোখ আটকে ছবিটি যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে, মানে ঋত্বিক ঘটকে! যে মানুষটি ভেতর থেকে মেনে নিতে পারেননি বাংলাদেশ-ভারতের ভাঙন। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঘটকের যে ক্ষত তার হৃদয়ে তৈরি হয়ে ছিল তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে সেই প্রমান তিনি রেখেছেন! মেঘে ঢাকা তারা থেকে যুক্তি তক্কো গপ্পো কোথায় নেই ঋত্বিকের দেশ ভাগের রক্তাক্ত দহন!

শঙ্খচিল

সিনেমা দেখার আগেই প্রচুর সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জেনেছি যে ছবিটি দেশভাগের গল্প নিয়ে নির্মিত। তারমানে ১৯৪৭ সালের সেই বুড়ো খুকোদের ভিমরুতির গল্প, আবার ইতিহাস, আবার পুরনো কাসুন্দি! কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়েছিল এতদিন পরে গৌতম ঘোষ কেনই বা দেশভাগ নিয়ে সিনেমা বানাবেন? দুই দেশের ভাঙন নিয়ে দীর্ঘদিন পর গৌতম ঘোষের হঠাৎ মন কেঁদে উঠার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই সেদিন মনে মনে খারিজ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সিনেমায় যখন দেখলাম ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক বয়ান নয় বরং দেশভাগত্তোর সময়ের গল্প শঙ্খচিল। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ের সীমান্ত এলাকার গল্প ‘শঙ্খচিল’-এর প্রেক্ষাপট। এমন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গৌতম ঘোষের সিনেমা বানানোর কারণ চাইলে সিনেমা শেষে একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার দখলের একটি নয়া কৌশল।’ ভদ্রলোকের এমন কথায় পাত্তা না দিলেও বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ-কলকাতার সিনেমা আমদানি-রপ্তানি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে গৌতম-প্রসেনজিতের দৌড়ঝাঁপও কথা মনে পড়লো। সেবার বাংলাদেশের নির্মাতা ও শিল্পগোষ্ঠির বাধায় সুবিধা করে উঠতে পারেনি গৌতম, প্রসেনজিৎ ও মমতা গং!

যাইহোক, গৌতমের শঙ্খচিলে ফিরি। মানবিক একটা গল্প বলার মধ্য দিয়ে গৌতম তার সিনেমায় ধর্ম, রাজনীতি দেখাতে যেয়ে কি একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেন। শঙ্খচিলের আগের ছবি শুণ্য অঙ্কতেও এমনটিই আমরা দেখেছি। আর এই ছবিতে জগাখিচুড়ি লাগালেন সীমান্তের মত জটিল, সংবেদনশীল ও রাজনৈতিক ছবির গল্পকে একটি মানবিক গল্প হিসেবে তুলে ধরার সরল ছেলেমানুষি করে! যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই।

সীমান্তকে সিনেমার বিষয়বস্তু করায় গৌতম ঘোষের শক্তপোক্ত কোনো যুক্তি পুরো সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্তত আমি পায়নি। তাই নিজেই বাধ্য হয়ে শঙ্খচিল সিনেমাটাকে গত বছরে বলিউডে মুক্তি পাওয়া ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যানের’-এর ক্রাইসিসের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলাম! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত কেতন মেহতার ওই ছবিটি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয় ছবিতে ‘পাহার’কে একটা ফ্যাক্ট মনে করেন। ঠিক সেই ছবির মত গৌতমের শঙ্খচিলে প্রধান বাধা দুই দেশের ‘কাঁটাতার’। মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’-এ দশরথ মাঝি বাস করতেন পাহারি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই বাস করেন তিনি। কিন্তু একদিন পাহার থেকে পরে গিয়ে মারাত্মাক আহত হন তার স্ত্রী। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিশাল এক পাহারের পেছনেই বড় হাসপাতাল, কিন্তু স্ত্রীকে পাহার ডিঙিয়ে নিয়ে যাওয়াতো সম্ভব না। সব ঘুরিয়ে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায় তার স্ত্রী। যদি বিশাল এই পাহারটা না থাকতো তাহলে হয়তো স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারতো, এই ক্ষোভ ঝেঁকে বসে বসলে প্রায় ২২ বছর টানা পাহার কেটে রাস্তা বানিয়ে ফেলেন দশরথ মাঝি। ঠিক এমনি সেম্পটমের দেখা মেলে ‘শঙ্খচিল’-এ মুনতাসির বাদল চৌধুরী নামের এক স্কুল মাস্টারের জীবনে। দশরথ মাঝির মত তার জীবনে বাধা হয়ে আসে দুই দেশের কাঁটাতার।

chk_captcha

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে রূপসাকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই নদী তীরবর্তি এলাকায় বাস করেন বাদল মাস্টার। মাস্টারের সব স্বপ্ন মেয়ে রূপসাকে ঘিরেই। মেয়ের মুখের হাসির জন্য সব করতে পারেন তিনি। মেয়ে চারদিকে হাসি খুশিভাবে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ের সমস্ত ছেলেমানুষিকেও আস্কারা দেন বাদল মাস্টার ও স্ত্রী লায়লা। এরইমধ্যে ভারতীয় সীমান্তের এক বিএসএফ সৈনিকের সঙ্গে পরিচয় হয় রূপসার। নিজের মেয়ের সঙ্গে রূপসার চেহেরার মিল থাকায় ওই জোয়ানটি তাকে মিষ্টি বলে ডাকে। এভাবেই সীমান্ত পাড়ের একটি পরিবার সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রূপসা। মেয়েকে নিয়ে চরম সংকট আর ভয়াবহ প্রশ্নের সামনে পতিত হয় বাদল মাস্টার। এতটুকু মেয়ের হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। শিগগিরই চিকিৎসা করতে হবে, তা না হলে কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। বাদল মাস্টার পড়েন মহা সংকটে। ভালো চিকিৎসার জন্য এই সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে দ্রুত সময়ে খুলনা কিংবা ঢাকা শহরে যাওয়ারও সময় নেই! তাই তার স্কুলের হিন্দু প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে খুলনা কিংবা ঢাকা নয়, তার দ্রুত সময় আর ভালো চিকিৎসার জন্য জীবনের রিস্ক নিয়ে অবৈধভাবেই সীমানা পাড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভারতের টাকি যায় বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী। যেখানে বাদল মাস্টারের বন্ধু তাদের দায়িত্ব নেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকিতেও হয়ে উঠে না রূপসার চিকিৎসা। তার হার্টের বাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কলকাতায় গিয়ে অপারেশন করানো ছাড়া আর কোনো গতন্ত্যর থাকে না। সেখানে গিয়েও বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী পড়েন মহা সংকটে। মুসলিম ধর্মের হয়েও শুধুমাত্র মেয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতার সুরম্য হাসপাতালে তাদেরকে হিন্দু নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়! এখানেও অস্তিত্বহীনতার আরোপিত সংকট দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন গৌতম ঘোষ।

ধর্ম নাহয় পরিবর্তন করে কলকাতার হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করলেন বাদল মাস্টার, কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি? তারও ব্যবস্থা করেন টাকির ওই দাদু, যার ভরসায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছেন বাদল মাস্টার। ভারতীয়দের এমনসব মহানুভবতা পুরো সিনেমায় হর হামেশায় দেখা মেলে। শেষ পর্যন্ত টাকার ব্যবস্থা হলেও মারা যায় রুপসা। মেয়ের মৃত্যুর পর ব্যাপক ক্ষোভে অবৈধভাবে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়ে আসার কথা বলে দেয় বাদল মাস্টার। ফলত তাদেরকে অবৈধ অভিবাসি আখ্যা দিয়ে ভারতীয় জেলে পুরে মেয়ে রুপসার মৃত লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর রূপক হিসেবে গৌতম ঘোষ দেখান যে, বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু শঙ্খচিল ভারতের সীমানায় উড়ে যাচ্ছে…

Shongkhachil

মূলত ছবির গল্প এতুটুকু। কিন্তু এই গল্প দিয়ে গৌতম ঘোষ কি বুঝাতে চাইলেন আসলে? সীমানা তুলে দেয়ার গল্প বললেন? মানবিকতার গল্প বললেন? নাকি এই ছবির বাদল মাস্টারের মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চাইলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্য হাহাকারটা শুধুই বাংলাদেশের মানুষের! ভারতের মানুষ আনন্দে আছে, ওইখানে মেলা হয়, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, সেখানের মানুষগুলো মহানুভবতায় ঠাসা, এইসব? পুরো সিনেমাতেইতো এমন দাদাগিরিটা টিকিয়ে রাখলেন গৌতম ঘোষ? এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে অসংখ্য বাংলাদেশির মৃত্যুর বিষয়টিকেও পা মাড়িয়ে গেলেন তিনি।

এই যেমন, সিনেমার প্রথমেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে যে বাংলাদেশির মৃত্যু হয় তার খুনের দায় বিএসএফ নিজের ঘাড়ে না নিয়ে বরং ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দিয়ে সাফাই গাইতে শুনি। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যখন খুনের দায় কার? কিংবা সীমান্ত হত্যার দায়তো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদেরই বলে জিজ্ঞেস করেন, তখন সীমান্ত প্রধানকে আমরা বলতে শুনি ‘এই খুনের দায় কোনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর না, বরং ব্লাডি হিস্টোরি’র!’

আহা, কতো চমৎকার উত্তর এই উচ্চপদস্ত কর্মকরতার! একেরপর এক ফেলানীর মত মানুষকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখবে ভারতীয় জোয়ানরা, আর তাদের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ক্ষোভ দেখিয়ে ইতিহাসকে গালাগাল করে চুপ মেরে যাবেন! কি হাস্যকর, আর মর্মান্তিক যুক্তি! বাস্তবেও কি তাহলে প্রত্যেকটা বাঙালির সীমান্ত দিতে গিয়ে খুন হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা এমনই ইতিহাসের উপর দায় চাপিয়ে দিয়েছেন, বা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ। এই দেশের মানুষের চেয়ে হয়তো ভারতের মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ সুবিধা বেশি পায়। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কেউ কেউ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় জীবনকে মুঠোবন্দি করে রাতের অন্ধকারে ভারত পাড়ি দিতে চায়। কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলানোর ঘটনায় কোনো রকমের তোয়াক্কা না করে, জবাবদিহিতার ধার না ধেরে বরং উল্টো সেইসব সীমান্তের খুনকে বৈধতা দেয়ার জন্য গৌতম ঘোষের মত নির্মাতারা সিনেমাকে ব্যবহার করতে পারেন না। এটা অন্যায়। এসব স্পর্শ কাতর বিষয় নিয়ে এমন সরল ছেলেখেলা বড়ই নির্মম। অন্তত আমাদের জন্য।

বাংলাদেশের দর্শকদের খুশি করার জন্য কলকাতার ভালো মন্দ দুই শ্রেণির মানুষকে দেখানোর মত হাস্যকর ব্যালেন্সও করেছেন গৌতম ঘোষ। এই যেমন কলাকাতায় মেয়ে রূপসার চিকিৎসা বাবদ ব্যয়ের জন্য বাদল মাস্টার তার স্ত্রীর গয়না বিক্রি করার টাকা যখন এক ধান্দাবাজ ভাগিয়ে নিতে চাইল সেই মুহূর্তটি, এবং কিছু মানুষ পরম মমতায় কলকাতার রাস্তা থেকে তাদের উদ্ধার করলো। এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে কলকাতার রাতের রাস্তায়ও হোন্ডাওয়ালা তরুণদের দৌরাত্ম দেখানোর শটটি একেবারেই বেমানান ছিল।

কিছু দৃশ্যমান অসঙ্গতি ছিল, যা চোখে বেশ দৃষ্টিকটু। এই যেমন পুরো সিনেমায় দর্শক জেনে এসেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় শুধু কাঁটাতার দিয়ে বিভাজন। রূপসাকে (সাঁঝবাতি) মাঝে মধ্যে দেখাও গেছে কাঁটাতারের ফাঁকা দিয়ে ভারতীয় সেই জোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মূল সংকটটা যখন সিনেমায় শুরু হলো, মানে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রূপসার চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছিলেন বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী, তখন দেখা যায় দুই দেশের সীমানা মানে মাঝখান দিয়ে একটা নদী!

পুরো ছবিতে অভিনয়ে সবাই নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন বলে মনে হয়। যদিও রূপসা চরিত্রে সাঁঝবাতির অভিনয়ই বেশি প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রত্যেকের অভিনয় ইন্টেনশনাল একটা সিনেমার প্রেক্ষাপটের কাছে ম্লান হয়ে গেল! এক ধরনের আরোপিত ট্র‌াজেডি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সিনেমার সমাপ্তির চেষ্টাও তাই বৃথা গেল।

দুটো বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সীমানা, প্রাচীর, কাঁটাতার তুলে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে ফ্যান্টাসাইজ করে শঙ্খচিলে মানবিক গল্প পরিবেশন করার যে কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন তার সিনেমায় তা ইতিমধ্যে অন্তত বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে যথেষ্ঠ হাস্যখোরাকের জন্ম দিয়েছে। তাই খুব সরলভাবেই বলা যায়, সীমানা নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের যে ক্ষত আর গৌতম ঘোষের যে ইন্টেনশন তা এক নয়। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঋত্বিকের হৃদয়ের ক্ষত শুধুমাত্র গৌতমের মত আলগা আবেগ দিয়ে মোড়ানো নয়। গৌতম ঘোষ ভালো নির্মাতা। কিন্তু সেই ভালো নির্মাতার প্রশংসাটা তিনি কালবেলা, পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা মনের মানুষের জন্য পাইতে পারেন, শঙ্খচিলের জন্য নয়।

সালমান শাহ: যে বাঁশি ভেঙে গেছে/ হাসনাত শোয়েব

 

‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে তারে কেন গাইতে বল?

কেন আর মিছেই তারে সুরের খেয়া বাইতে বল?’

১৯৯৬ সালে আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। সে বয়সের স্মৃতি মনে থাকাটা স্বাভাবিক না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার তেমন কিছু মনে নেই। শুধু ঝাপসা ঝাপসাভাবে দুটি ঘটনা কেবল মনে করতে পারি। এক শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জয়। আর দুই সালমান শাহ’র মৃত্যু। অর্থ্যৎ ক্রিকেট বিশ্বে নতুন তারকার উত্থান এবং বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নক্ষত্রের পতন।

salman-edit Cover 01

সালমান শাহর মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের শিল্পের জন্য কতটা ভয়াবহ ছিলো তা সালমানের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দিকে চোখ ফেরালেই বুঝা যাবে। সালমানের মৃত্যু চলচ্চিত্র শিল্পে অদ্ভুত এক স্থবিরতা এনে দিয়েছিলো। যেনো কারো কিছু করার নেই। সালমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ওমর সানীও কোন এক অজানা কারণে সিনেমা থেকে দূরে সরে গেলেন। ফেরদৌস-রিয়াজরা এসে সেই হাল ধরার চেষ্টা করলেও ততদিনে দর্শকও কেমন জানি ম্যানিয়াক হয়ে গেলো। তারপর চলচ্চিত্রকে চালানোর জন্য কাটপিসের আমদানি করতে হলো। এক শ্রেণির দর্শক তাতে সাড়া দিলেও মধ্যবিত্ত দর্শকের বৃহত্তর অংশ হা-পিত্যেস করতে করতে বাংলা সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো। ঐ সময় একমাত্র মান্নাই মূলত নিম্নবর্গীয় দর্শককে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। যা ক্রমান্বয়ে তাদের মাঝে মান্নাকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিলো। মান্নার মৃত্যুর পর তার জানাজায় মানুষের ঢলই বলে দিয়েছিলো তাদের কতটা কাছে ছিলেন তিনি। কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে সিনেমাকে নিয়ে যাওয়ার অথবা দর্শককে সিনেমার কাছে নিয়ে আসার কোন কাজই সিনেমার কুশীলবরা তখন করতে পারেন নি।

মূলত আশির শেষ এবং নব্বই শুরু থেকেই বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায়ীক দিক থেকে তুঙ্গে অবস্থান করছিলো। ঐ সময়ের চলচ্চিত্রের অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাতকারে সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী বলছেন, দর্শক সে সময় মূলত চারভাগে বিভক্ত ছিলো। এক ভাগে ছিলো রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনরা, দ্বিতীয় ভাগে ছিলো রুবেল, তৃতীয় ভাগে ছিলো শাবানা। আর অন্য ভাগে ছিলাম আমি (ওমর সানী) আর সালমান।

ওমর সানীর এই কথা ধরে বলা যায় ঐ সময় বেশিরভাগ নায়ক-নায়িকারা নিজেদের জন্য দর্শক শ্রেণী তৈরি করতে পেরেছিলো। যা সে সময় সব শ্রেণীর দর্শককে হলে নিয়ে আসতে পেরেছিলো। তাই ব্যবসায়ীক দিক থেকেও চলচ্চিত্রগুলো সফলতা পেয়েছিলো।

কিন্তু এসব কিছুর পরেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে সালমানের আগমন একটা টার্নিং পয়েন্ট বটে। সালমান মূলত গতানুগতিক ধারাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। সালমান মোট অভিনয় করেছেন ২৭ টি ছবিতে। যার মধ্যে মাত্র তিন কি চারটি ছবি ব্যাবসায়ীকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো। এমন কোন এক্সপেরিমেন্টাল ছবিতে অভিনয় করেন নি তিনি। সবই ছিলো সামাজিক ঘটনা নির্ভর ছবি। প্রেম-সামাজিক অবক্ষয়- গুড ভার্সেস এভিলের লড়াই, ধনী-গরীব বৈষম্য এবং অবশেষে হ্যাপি এন্ডিং। এসব ডিসকোর্সের মধ্যেই সিনেমার মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছিলো। তবে তখনকার নায়করা সিনেমার শেষে মরতে না চাইলেও সালমান বেশ কয়েকটি ছবিতে মরার সাহস করেছিলেন। তিনি তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ এ মৃত্যুর দৃশ্যে অভিনয় করার সাহস দেখিয়েছিলেন। শুধু সালমান না, ঐ সিনেমার নায়িকা মৌসুমীও মরেছিলেন তার সাথে।

সালমান নিয়ে বলতে গিয়ে সানীর ভাষ্য, ওই সময়ে সালমান ছিলো স্টার। কিন্তু মৃত্যুর পর দর্শক তাকে সুপারস্টার বানিয়েছে। অর্থ্যাৎ সানীর কথা যদি সত্য ধরে নেই তবে মৃত্যু সালমানের জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়িয়েছে, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা সে হারেই কমিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো একটি স্টেরিওটাইপ ধারার মধ্যে সালমান এমন কী করেছিলেন যা তাকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো? সালমান প্রথমত নিজেকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তিনি হয়তো আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম স্টাইল আইকন। কখনো পনিটেল, কখনো কাউবয় হ্যাট আবার কখনো অভিনব গগলস। পোশাকেও নতুনত্ব এনেছিলেন সালমান। এসবই তাকে মধ্যবিত্ত বাঙালি তরুণদের কাছে আইডল এবং তরুণীদের কাছে স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো। যাদের কেউ কেউ সালমানের মৃত্যুর পর আত্মঘাতী হয়েছিলো। আর যারা বেঁচে ছিলেন তারা এক রহস্যময় অভিমান নিয়ে সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিলো।

Poster Compile

সালমান মূলত মধ্যবিত্তের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেই চরিত্র, যাকে মধ্যবিত্ত তাদের আপন ভাবতে পেরেছিলো। অনেক দূরের হয়েও যিনি ছিলেন খুব কাছের। বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফির জনপ্রিয়তাকে হয়তো সালমানের জনপ্রিয়তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যারা সুপারস্টার হওয়ার পরও মধ্যবিত্তের কাতারে শামিল হয়েছেন অতি সাধারণ একজন কাছের মানুষের মতো । এখানে অন্যান্য তারকাদের চেয়ে এক ধাক্কায় আলাদা হয়ে যান তারা।

অভিনয়েও সালমান ছিলেন সাবলীল। যেকোন ধরনের চরিত্রের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অসামান্য এক গুণ ছিলো তার। তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখে কেউ বলবে না এটা তার প্রথম ছবি। মনে রাখা দরকার এই একই চরিত্রে অভিনয় করে অভিষেক হয়েছিলো বলিউড সুপারস্টার আমির খানেরও। কিন্তু দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলে বলা যেতে পারে তর্কযোগ্যভাবে সালমানের অভিনয় আমিরের চেয়ে ভালো ছিলো। এছাড়া ‘বিক্ষোভ’এর দেশপ্রেমিক যুবক, ‘আনন্দ অশ্রু’র পাগল খসরু, ‘মায়ের অধিকার’র রাগী যুবক অথবা ‘তোমাকে চাই’র প্রেমিক যুবক। সব চরিত্রেই সহজাত অভিনয় করে দেখিয়েছেন সালমান।

তবে তার সময়ের বা তারও আগের অন্য নায়কদের চেয়ে সালমানের পার্থক্য হলো সালমান সচেতন বা অবচেতনে ‘মেলোড্রামা

‘কে নিজের অভিনয় থেকে বাদ দিতে পেরেছিলেন। অথচ একই ধরনের কাহিনীর মধ্যেই অন্যরা বেশিরভাগ সময় তাল রাখতে পারেন নি। সালমানের আগে এই কাজটি সম্ভবত রাজ্জাক এবং কিছুটা পেরেছিলেন আলমগীর।

আগেই বলেছি সালমানের সিনেমা ‘আলাদা’ কিছু  বলে নাই। ওই সময়ের আর দশটা জনপ্রিয় ধারার সিনেমার মতোই সালমানের ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সালমানের বয়ান ভঙ্গিমা ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। পরিমিতিবোধ, প্রেজেন্টেশন, স্টাইল এবং সালমানের স্বকীয়তা সেইসব সিনেমাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সালমান ছিলেন অভিনেতা। যেটুকু চরিত্র পেয়েছেন সেখানে নিজের রঙ ঢেলে দিয়েছেন। আজ যখন মেইনস্ট্রিম সিনেমার বাইরে গিয়ে অনেক নির্মাতা কাজ করছেন তখনই সালমানের অভাব আরো বেশি বেশি অনুভব হচ্ছে। পশ্চিম বাংলার নায়ক প্রসেনজিতের দিকে তাকালেই তা বুঝা যায়। এক সময়ের বানিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় এই নায়ক মেইনস্ট্রিমের বাইরে গিয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সালমানও নিঃসন্দেহে সে জায়গায় পৌছতে পারতেন অনায়সে। কিন্তু মৃত্যু সেসব সম্ভাবনার গায়ে নোকতা বসিয়ে দিয়েছে।

শুধু চলচ্চিত্রে না, বাংলা নাটকেও সালমান তার স্বকীয়তা দেখিয়েছেন। অভিনয় জীবনে মোট ৮ টি নাটকে অভিনয় করেছেন সালমান। এর মধ্যে ‘নয়ন’ তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের যখন তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি নয়নে অভিনয় করেন। এই নাটকে একজন মাস্তানের ভূমিকায় অভিনয় করে সফল সালমান। অথচ যে সময়ে তিনি নাটকটি করেন অন্য কেউ হলে এরকম চরিত্রে অভিনয় করার সাহস করতেন না। একটু উনিশ-বিশ হলে যা তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলতে পারতো। কিন্তু নাটকটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ‘নয়ন’ সে বছর বাচচাস এর শ্রেষ্ঠ নাটকের পুরস্কার পেয়েছিলো। সালমান মূলত যেখানেই হাত দিয়েছিলেন সেখানেই সফল হয়েছিলেন।

সালমান পরবর্তী সময়ে অনেকেই সালমানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সালমান কেবলই সালমান। হয়তো আধুনিক বাংলা সিনেমার অন্যতম মায়েস্ত্রো। যার অকাল মৃত্যু এক ঘোর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিলা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতকে। অনেকদিন পর এসে অনেকেই চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সিনেমাকে তার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ততদিনে পানি গড়িয়ে গেছে অনেকদূর। একের পর এক হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।  এর  মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত দর্শকরা। মধ্যবিত্তের ঘুম বরাবরই রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো। সে ঘুম সহজে ভাঙে না। তবে সরওয়ার ফারুকী কিংবা তারেক মাসুদদের লড়াই বাংলাদেশের সিনেমাকে নতুন মোড় দিয়েছে। আবার অন্যদিকে শাকিব বা অনন্তরা সংকটকালীন সময়ে চলচ্চিত্রকেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্তের একটা নগন্য অংশ ইতোমধ্যে হলে ফিরতে শুরু করেছে। তবে আগের সেই ‘গণজোয়ার’ এখনো বহদূর। দিল্লি এখনো তাই দূর অস্তই বটে। তবে একদিন হয়তো দিন ফিরবে। যেদিন সকলে এক কাতারে হলের দিকে মুখ ফেরাবে। কিন্তু কে জানে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর না আসলে, আজ হয়তো সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকতে হতো না।

 

নতুন চোখে পথের পাঁচালী দেখা/রুহুল মাহফুজ জয়

১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট। কলকাতা ও শহরতলীর নয়টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল একটি ছবি।এ ছবির শুটিং শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। পথের পাঁচালী। বাংলা সিনেমা তো বটেই, যে ছবি মুক্তির পর বদলে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমার ভাষা। যে ছবি মুক্তির পর থেকেই পৃথিবীব্যাপী নবীন চলচ্চিত্র পরিচালকদের স্বপ্নের প্রেরণা।৭০ হাজার টাকা বাজেটের পথের পাঁচালী পা দিলো ষাট বছরে। আমেরিকা মুলুকে ফোরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছবিটার প্রিন্ট সংস্কার হয়েছে সম্প্রতি।

দূর্গা ও অপুর বাবা হরিহর চরিত্রে অভিনয় করা কানু ব্যানার্জি আর দু:সম্পর্কের পিসি ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রে অনবদ্য অভিনেত্রী চুনিবালা দেবীর জন্য বোড়াল গ্রামে যে মাটির বাড়ি আর উঠান ভাড়া নেয়া হয়, তার জন্য শুটিং ইউনিটকে মাসিক ভাড়া দিতে হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। চুনিবালা দেবীর রোজ পারিশ্রমিক ছিল ২০ টাকা। অপু চরিত্রের সুবীর বন্দোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি। শুটিং শেষে সুবীরের বাবার হাতে সত্যজিৎ রায় ২৫০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন।ছবি মক্তির পর এই মানুষগুলোই বিশ্ব চলচ্চিত্রের অমর মুখ।

পথের পাঁচালী নিয়ে লিখতে বসে আসলে ভাষাহীনতায় ভুগছি। অতিমুগ্ধতা আর অতিপ্রেম মনে হয় প্রেমিক-প্রেমিকা। পুরা লায়লা-মজনু টাইপ। এই দুইটা বিষয় মেটাফিজিক্যাল জগত থেকে মানুষকে একটা স্ট্যাটিক জগতের সামনে দাঁড় করায়ে দেয়। তা কিছুক্ষণের জন্য হলেও। আর পথের পাঁচালী সিনেমার দর্শককে এই অভিজ্ঞতা দিচ্ছে গত ষাট বছর ধরে। দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।

সম্প্রতি ছবিটা আবার দেখলাম। আবারও বাংলা সিনেমার ‘মাণিক’কে সিন ধরে ধরে প্রণাম দিলাম মনে মনে। পথের পাঁচালী যতবারই দেখি, কম করে হলেও নিজের শৈশবের নব্বই শতাংশ সিনামেটিক ইমেজে দেখতে পাই। নমস্কার সত্যজিৎ রায়…নমস্কার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।

পথের পাঁচালী ছবিটা শুরুর তৃতীয় দৃশ্যেই আমি নিজের শৈশবে ফিরে যাই। ছোট্ট দূর্গা বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে,তার ভেতর একটা লুকোচুরি ভাব—এই দৃশ্য থেকে যতবার ওই বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে দূর্গা আর অপু চলাচল করেছে (হোক দৌড়ে বা হেঁটে), ততবারই মনে হয়েছে ওরা আমার ছোটফুপি আর ছোটকাকা। দূর্গার মুখায়বে আমি মাঝেমাঝে পারু খালার মুখটাও বসায়ে দেই। সেই কৌতুহলী চোখে, সেই চঞ্চলতা, সেই ডুরে শাড়ি। অপু কখনও কখনও আমার ছোটকাকা, কখনও আমি নিজেই।

সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কাজ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মিউজিক পথের পাঁচালীকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। ছোট থেকে বড়, পথের পাঁচালী ছবির প্রতিটি চরিত্রের ডিটেল অসাধারণ। মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা মিঠাই বিক্রেতা বা পাঠশালার পণ্ডিত—স্ক্রিনে জায়গা পেয়েছেন দু’একবার। কিন্তু তাদের চরিত্র ভুলবার নয়। এমনকী ছবির কুকুর-বিড়ালগুলোও না।

দূর্গা, অপু আর সর্বজয়া— দুই ভাই-বোন ও তাদের মা পথের পাঁচালীর মূল চরিত্র। কখনও কখনও আমার কাছে মনে হয়েছে, এই তিনজনকে ছাপিয়ে গেছেন বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুণ। মনে হয় এই চরিত্রটাই পথের পাঁচালীর সবচে শক্তিশালী চরিত্র। এই ছবিতে অভিনয় করা কাউকেই মনে হয়নি অভিনয় করেছেন। কিন্তু চুনিবালা দেবীর জন্ম আর ৮৩ বছরের জীবনপ্রাপ্তি যেন পথের পাঁচালীর ‘ইন্দির ঠাকরুণ’ হবার জন্যই। ছবিটা যে বছর মুক্তি পায়, সে বছরই মারা যান চুনিবালা। বিশ্ব সিনেমার সৌভাগ্য,এমন একজন অভিনেত্রীকে সত্যজিৎ রায় খুঁজে বের করেছিলেন। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে পথের পাঁচালী যেমন আজও প্রিয়,তেমনি মৃত্যুর ৬০ বছর পরেও চুনিবালা দেবী বেঁচে আছেন। তবে চুনিবালা হিসাবে নন, ইন্দির ঠাকরুণ পরিচয়ে। এখানেই নির্মাতা সত্যজিৎ বা অভিনেত্রী চুনিবালার সার্থকতা। এ ছবিতে অভিনয় করা অনেকেই পরে আর পর্দায় আসেননি, কিন্তু তারা অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসাবে জগৎখ্যাত। তা পথের পাঁচালীর সৌজন্যে।

পথের পাঁচালীতে ধনী-নির্ধন, ক্ষুধা আর সুখের মধ্যবর্তী যে সংকট, তার পুরোধা বৃদ্ধা ইন্দির। তার গপগপ করে ভাত খাওয়া এবং সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট দূর্গার ঢেঁকুর তোলার যে দৃশ্য, তার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই ক্ষুধার সরলীকরণ। সংবেদনশীলতা। আশি বছর বয়সী একজন মানুষের জন্য ক্ষুধা যেরকম, সাত-আট বছর বয়সীর জন্যও ঠিক সেরকমই।

নুন আনতে পানতা ফুরানো হরিহর-সর্বজয়ার সংসারে দুই সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না ঠিকমতো। সেখানে ইন্দির এক প্রকার বোঝা। বৃদ্ধা তা বোঝেন এবং মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এখানে অসহায় ইন্দির ঠাকরুণের প্রতিবেশ-পরিস্থির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার যে সংগ্রাম, তা আশ্রয়হীন মানুষের চিরায়ত। ইন্দিরের হাঁটা-চলা, অসহায় তাকিয়ে থাকা যেন মৃত্যুমুখী মানবতার চিত্র।

দূর্গা-অপুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রাত্তিরে ইন্দির ঠাকরুণের গল্প বলার দৃশ্যটা একবার মনে করে দেখুন। কি চমৎকার সিনেমাটিক ইমেজের সৃষ্টি! তিনি রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলছেন। দেয়ালে ইন্দিরের মুখের অবয়বটা এমনভাবে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে যে, ওই ছায়াটাই যেন রাক্ষস! ছবিতে ইন্দির ঠাকরুণের কণ্ঠে একটা গান আছে, “যারা পরে এলো, আগে গেলো, আমি রইলাম পড়ে… ওরে দিন যে গেলো, সন্ধ্যে হলো, পাড় করো আমারে”। কোন বাংলা সিনেমায় চরিত্রের সঙ্গে গানের এমন যুক্তিযুক্ত ব্যবহার আর কি হয়েছে? মনে করতে পারছি না।

সর্বজয়া ইন্দির ঠাকরুণকে রাখতে চান না নিজেদের বাড়িতে। চলে গেলেই খুশি হন। দুবার তাড়িয়েও দিয়েছেন। আবার সম্মানহানির ভয়ে আশ্রয়ও দেন। সর্বজয়ার এই সাইকোলজিক্যাল টানাপোড়েন এক কথায় অসাধারণ। আমার মতে, পথের পাঁচালী ছবির বড় সম্পদ। আশ্রয়হীন ইন্দির শেষবার যখন বাপের ভিটায় ফিরে এলো, তার চোখে-মুখে ছিলো মৃত্যুছায়া। তাকে জলপান করিয়ে বিদায় দিলো সর্বজয়া। যে বারান্দায় শুয়ে ইন্দির ঘুমাতো, সেখান একটি কুকুর খেলছে। ওদিকে তাকিয়ে সদর দরজা পার হয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই দৃশ্যের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় হয়তো সেই বার্তাটিই দিয়েছেন— কুকুর-বিড়ালের আশ্রয় আছে, দু বেলা খাবার আছে, মানুষের কাছে তবু মানুষেরই ঠাঁই নেই। পুঁজিবাদী মানসিকতা শুধু যে বিত্তশালীদের মধ্যেই থাকে, তা না। নুন আনতে পানতা ফুরায় টাইপের পরিবারে ‘বিলং’ করা মানুষের মধ্যেও তা লুকিয়ে থাকে। এমনকী নারীদের মধ্যেও। সর্বজয়া আর ইন্দির ঠাকরুণের মধ্যে টানাপোড়েন তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।

ইন্দিরের মৃত্যুদৃশ্যটা করুণ। সেই মৃত্যুদৃশ্যের আগে বাঁশবাগানে বসে বৃদ্ধার ঠিকানাহীনতা বা আশ্রয়হীনতার রিক্ত চাহনি দর্শকের বুকে হাহাকার তৈরি করে; সর্বজয়ার প্রতি কিছুটা হলেও ঘৃণা। ইন্দির ঠাকরুণের করুণ মৃত্যুর জন্য হয়তো অনেক দর্শক সর্বজয়াকে ক্ষমাও করেনি। যদিও ইন্দিরের মৃত্যু ঢেকে গেছে দূর্গার মৃত্যুতে। বৃদ্ধা পিসির অসহায়ত্বকে ছাপিয়ে গেছে জ্বরের ঘোরে কিশোরী ভাইজির ছোট ভাইকে বলা, “এবার জ্বর ছাড়লে রেলগাড়ি দেখতে যাবো রে”। দূর্গার আরেকবার রেলগাড়ি দেখা হয় না। জ্বরে দূর্গার মৃত্যু, অসহায়ত্বে সর্বজয়ার কান্না দর্শক হৃদয়ে এক চিরহাহাকারের জন্ম দেয়। যে হাহাকারের স্রোতে ভেসে যায় ইন্দির ঠাকরুণের করুণ জীবন ও মৃত্যু। একটা নতুন বড় দু:খ, চারপাশের আর সব ছোট-বড় দু:খকে এভাবেই গ্রাস করে ফেলে সবসময়।

তারও আগে-পরে পুরো ছবি জুড়ে দর্শকরা দেখে দুই ভাই-বোনের দূরন্ত কৈশোর। বাঙালি দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোর যে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের চেয়ে অনেক বেশি দূরন্ত আর দু:সাহসিক হয়, পথের পাঁচালী যেন তারও ছায়াচিত্র। আমরা দেখি, মিঠাইওয়ালার পিছু পিছু ছুটছে অপু, দূর্গা আর তাদের কুকুর। লং শটে পথের পাশে পুকুরের পানিতে তাদের চলমান প্রতিবিম্ব। সে এক দৃশ্য বটে!

বাঁশবনে চড়ুইভাতিতে স্বাভাবিক কৈশোরের দুরন্তপনার পর আমরা দেখি, সমবয়সী সখীর বিয়ের আসরে দূর্গার চোখে জল। পয়সাওয়ালা পরিবারের মেয়ে হলে তারও যে এতদিনে বিয়ে হতো, সেই ভাবনাতেই হয়তো এই কষ্ট। যা সইতে না পেরে চোখের কোনে জল হয়ে ঝরে পড়েছে। নিজের বিয়ের জন্য দূর্গাকে খেলার ছলে শ্লোক পড়তেও দেখে দর্শক। ছবির বেশ কিছু দৃশ্যেই দূর্গা চরিত্রের মাধ্যমে যৌবনোন্মুখ সময়ে মেয়েদের অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আমার আট-দশ বছর বয়সে যখন আমাদের গাঁয়ে প্রথম বিদ্যুত এলো, মুরব্বীদের নিষেধ সত্বেও বিদ্যুতের খুঁটিতে কান পাততাম। ঝিম মারা একটা শব্দ আর কম্পন পাওয়া যেতো তাতে। সেই ঘটনা নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের। তখন থেকে চল্লিশ বছর আগেই যে এই দৃশ্য পথের পাঁচালীতে ধারণ হয়েছে, তা জানাই ছিলো না। কাশবন পেরিয়ে অপু-দূর্গার প্রথম ট্রেন দেখার মুহূর্তটা বিশ্ব সিনেমার কালজয়ী একটা মুহূর্ত বা দৃশ্য হয়ে আছে। ট্রেন দেখাটাও যে একটা বড় মোহ, বাঙালির ছোটবেলার চেয়ে তা কে আর ভালো জানে!দূর্গা-অপুর বৃষ্টিতে ভেজার মতো দৃশ্যকাব্য আর কটা ছবিতে আছে, এতটা আবেদন নিয়ে! যদিও সেই বৃষ্টি বিরাট এক ট্র্যাজেডির কারণ।

পথের পাঁচালীর শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি,স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কাশী চলে যাচ্ছেন হরিহর; জীবনের বাঁক বদলের আশায়। এই যাত্রা আসলে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশে গ্রামীণ জীবন থেকে শহুরে জীবনে প্রবেশযাত্রা। যে যাত্রার বিকাশ স্পষ্টত ‘অপরাজিত’ হয়ে ‘অপুর সংসার’ ছবিতে গিয়ে থেমেছে। গ্রামের একটা সাধারণ পরিবারের ছেলে ‘অপু’ কিভাবে আধুনিক, শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, তা জানতে হলে দর্শককে ‘অপু ট্রিলজি’ দেখতে হবে। যার শুরুটা ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে।

দুনিয়ার হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি থেকে একদম সাধারণ দর্শক, সবার কাছে ‘পথের পাঁচালী’ কেন প্রিয় সিনেমা হয়ে উঠলো? তা ভাবতে গিয়ে যে উত্তর পেলাম, তা এরকম— সেলুলয়েডে সত্যজিৎ রায়ের গল্প বলার সততা, অর্থাৎ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা আর পরিচালক সত্যজিৎ’র সিনেমাটিক ইমেজের রসায়নটা এমন খাপে খাপ হয়েছে যে, পথের পাঁচালী হয়ে উঠেছে ‘বাঙালিত্ব’ আর বাঙলা জনপদের সত্যিকারের ছবি। যা হাজার বছরের। অপু-দূর্গা পথের পাঁচালী সৃষ্টির আগেও ছিলো, বিভূতির সময়ে ছিলো, সত্যজিৎ’র সময়ে ছিল, আছে এখনও।

দরিদ্রতা যে সকল বাঙালির ঘরে ছিল বা আছে, পথের পাঁচালীর অপু-দূর্গা আর তার পরিবারের ছবিটা সেখানে চিরকালীন। কিশোরী দূর্গার মানসিক টানাপোড়েন, আনন্দ-বিষাদ গাঁয়ের কোন বাঙালি কিশোরীর নেই? প্রাচ্য, পাশ্চাত্য বা ল্যাটিন, সকল সমাজেই তো কৈশোরের দূরন্তপনা একই রকম হবার কথা। আর্থ-সামাজিক যে বক্তব্য পথের পাঁচালীতে তুলে ধরা হয়েছে, তা যেমন আমেরিকাতে আছে; আছে সুদান, নিকারাগুয়া বা আর্হেন্তিনাতেও। সারা পৃথিবী জুড়েই আসলে কৈশোর আর দারিদ্রের ভাষা এক। পথের পাঁচালী তাই একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে দুঁদে, সবারই ছবি।পথের পাঁচালী বুঝলে আসলে বাঙালির মন বোঝা যায়, যা আবহমান।

 

শুনতে কি পাও: আমার সিনেমা দর্শন/ইলিয়াস কমল

শুনতে কি পাও

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালো’র কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি “শুনতে কি পাও” এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি ‘শুনতে কি পাও’ এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসব ‘সিনেমা দ্যু রিলে’ মূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ ছবি’রপুরষ্কার ‘গ্রা প্রী’ পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। ক’দিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে।
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে ‘আম’ পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।
বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের।