গৌতম ঘোষের সরল ছেলেমানুষি ও সীমান্তের শঙ্খচিল/মিতুল আহমেদ

প্রায় তিন বছর পর সিনেমায় হাত দিলেন গৌতম ঘোষ। তাও দুই দেশের যৌথ নির্মাণ!এর আগেও যৌথ উদ্যোগে সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। তবে এবারেরটা ভিন্ন। আগে যে দুটি যৌথ সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা তার আছে তা মূলত ছিলো দুটি তৈরি করা গল্পের অ্যাডাপটেশন! একটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, আর অন্যটা সুনীল গাঙ্গুলীর মনের মানুষ। দুটো ছবি ভারতে কেমন সাড়া ফেলেছিল তা অজানা থাকলেও বাংলাদেশে ছবি দুটো উচ্চ ও বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। ফলে গৌতম ঘোষের ছবি মানেই উচ্চ মহলে, বুদ্ধিজীবী মহলে পর্যাপ্ত গুরুত্বসহ নেয়া হয় এটা একরকম প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর গৌতম ঘোষ নিজেও এমনটি জানেন বলেই হয়তো এবার কোনো ধরনের অ্যাডাপটেশনে না গিয়ে নিজের একটি মৌলিক অথচ ‘উদ্ভট’ ও যুক্তিহীন গল্পের একটা সিনেমা নিয়ে পরম আশাবাদী হয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশে!

gowtom ghosh

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কাঁটাতার বিষয়ক জটিলতার মত স্পর্শকাতর গল্প নিয়ে নির্মিত ‘শঙ্খচিল’ নামের সিনেমাটি বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকদের খাওয়াতে পরম আশাবাদী হয়ে গত ১২ এপ্রিল গৌতম ঘোষ ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে। সেদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎসহ বাংলাদেশের উচ্চমানের দর্শকেরা! আর সেখানেই এলিট মানুষের সাথে এলিট একটা ভাব নিয়ে দেখা ফেলা গেল ছবিটি! এবং কাকতালীয়ভাবে নির্মাতা গৌতম ঘোষের পাশে বসেই! না না, এক হল রুমের কথা বলছি না, সত্যি সত্যিই একেবারে পাশাপাশি বসে!ফলে সিনেমায় যে জায়গাগুলোকে তিনি ‘কি পয়েন্ট’ মনে করেছেন, এবং ঘাড় উল্টিয়ে হলভর্তি দর্শকদের দিকে বারবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করেছেন সে বিষয়গুলো বিশেষ নজর কেড়েছে।

সীমান্তে নিহত আলোচিত বাংলাদেশের মেয়ে ফেলানির মত কাঁটাতারে ঝুলে থাকা একটা লাশের দৃশ্যের মাধ্যমে শুরু হয় সিনেমা। তার আগে চোখ আটকে ছবিটি যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে, মানে ঋত্বিক ঘটকে! যে মানুষটি ভেতর থেকে মেনে নিতে পারেননি বাংলাদেশ-ভারতের ভাঙন। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঘটকের যে ক্ষত তার হৃদয়ে তৈরি হয়ে ছিল তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে সেই প্রমান তিনি রেখেছেন! মেঘে ঢাকা তারা থেকে যুক্তি তক্কো গপ্পো কোথায় নেই ঋত্বিকের দেশ ভাগের রক্তাক্ত দহন!

শঙ্খচিল

সিনেমা দেখার আগেই প্রচুর সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জেনেছি যে ছবিটি দেশভাগের গল্প নিয়ে নির্মিত। তারমানে ১৯৪৭ সালের সেই বুড়ো খুকোদের ভিমরুতির গল্প, আবার ইতিহাস, আবার পুরনো কাসুন্দি! কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়েছিল এতদিন পরে গৌতম ঘোষ কেনই বা দেশভাগ নিয়ে সিনেমা বানাবেন? দুই দেশের ভাঙন নিয়ে দীর্ঘদিন পর গৌতম ঘোষের হঠাৎ মন কেঁদে উঠার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই সেদিন মনে মনে খারিজ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সিনেমায় যখন দেখলাম ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক বয়ান নয় বরং দেশভাগত্তোর সময়ের গল্প শঙ্খচিল। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ের সীমান্ত এলাকার গল্প ‘শঙ্খচিল’-এর প্রেক্ষাপট। এমন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গৌতম ঘোষের সিনেমা বানানোর কারণ চাইলে সিনেমা শেষে একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার দখলের একটি নয়া কৌশল।’ ভদ্রলোকের এমন কথায় পাত্তা না দিলেও বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ-কলকাতার সিনেমা আমদানি-রপ্তানি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে গৌতম-প্রসেনজিতের দৌড়ঝাঁপও কথা মনে পড়লো। সেবার বাংলাদেশের নির্মাতা ও শিল্পগোষ্ঠির বাধায় সুবিধা করে উঠতে পারেনি গৌতম, প্রসেনজিৎ ও মমতা গং!

যাইহোক, গৌতমের শঙ্খচিলে ফিরি। মানবিক একটা গল্প বলার মধ্য দিয়ে গৌতম তার সিনেমায় ধর্ম, রাজনীতি দেখাতে যেয়ে কি একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেন। শঙ্খচিলের আগের ছবি শুণ্য অঙ্কতেও এমনটিই আমরা দেখেছি। আর এই ছবিতে জগাখিচুড়ি লাগালেন সীমান্তের মত জটিল, সংবেদনশীল ও রাজনৈতিক ছবির গল্পকে একটি মানবিক গল্প হিসেবে তুলে ধরার সরল ছেলেমানুষি করে! যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই।

সীমান্তকে সিনেমার বিষয়বস্তু করায় গৌতম ঘোষের শক্তপোক্ত কোনো যুক্তি পুরো সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্তত আমি পায়নি। তাই নিজেই বাধ্য হয়ে শঙ্খচিল সিনেমাটাকে গত বছরে বলিউডে মুক্তি পাওয়া ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যানের’-এর ক্রাইসিসের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলাম! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত কেতন মেহতার ওই ছবিটি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয় ছবিতে ‘পাহার’কে একটা ফ্যাক্ট মনে করেন। ঠিক সেই ছবির মত গৌতমের শঙ্খচিলে প্রধান বাধা দুই দেশের ‘কাঁটাতার’। মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’-এ দশরথ মাঝি বাস করতেন পাহারি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই বাস করেন তিনি। কিন্তু একদিন পাহার থেকে পরে গিয়ে মারাত্মাক আহত হন তার স্ত্রী। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিশাল এক পাহারের পেছনেই বড় হাসপাতাল, কিন্তু স্ত্রীকে পাহার ডিঙিয়ে নিয়ে যাওয়াতো সম্ভব না। সব ঘুরিয়ে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায় তার স্ত্রী। যদি বিশাল এই পাহারটা না থাকতো তাহলে হয়তো স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারতো, এই ক্ষোভ ঝেঁকে বসে বসলে প্রায় ২২ বছর টানা পাহার কেটে রাস্তা বানিয়ে ফেলেন দশরথ মাঝি। ঠিক এমনি সেম্পটমের দেখা মেলে ‘শঙ্খচিল’-এ মুনতাসির বাদল চৌধুরী নামের এক স্কুল মাস্টারের জীবনে। দশরথ মাঝির মত তার জীবনে বাধা হয়ে আসে দুই দেশের কাঁটাতার।

chk_captcha

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে রূপসাকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই নদী তীরবর্তি এলাকায় বাস করেন বাদল মাস্টার। মাস্টারের সব স্বপ্ন মেয়ে রূপসাকে ঘিরেই। মেয়ের মুখের হাসির জন্য সব করতে পারেন তিনি। মেয়ে চারদিকে হাসি খুশিভাবে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ের সমস্ত ছেলেমানুষিকেও আস্কারা দেন বাদল মাস্টার ও স্ত্রী লায়লা। এরইমধ্যে ভারতীয় সীমান্তের এক বিএসএফ সৈনিকের সঙ্গে পরিচয় হয় রূপসার। নিজের মেয়ের সঙ্গে রূপসার চেহেরার মিল থাকায় ওই জোয়ানটি তাকে মিষ্টি বলে ডাকে। এভাবেই সীমান্ত পাড়ের একটি পরিবার সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রূপসা। মেয়েকে নিয়ে চরম সংকট আর ভয়াবহ প্রশ্নের সামনে পতিত হয় বাদল মাস্টার। এতটুকু মেয়ের হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। শিগগিরই চিকিৎসা করতে হবে, তা না হলে কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। বাদল মাস্টার পড়েন মহা সংকটে। ভালো চিকিৎসার জন্য এই সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে দ্রুত সময়ে খুলনা কিংবা ঢাকা শহরে যাওয়ারও সময় নেই! তাই তার স্কুলের হিন্দু প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে খুলনা কিংবা ঢাকা নয়, তার দ্রুত সময় আর ভালো চিকিৎসার জন্য জীবনের রিস্ক নিয়ে অবৈধভাবেই সীমানা পাড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভারতের টাকি যায় বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী। যেখানে বাদল মাস্টারের বন্ধু তাদের দায়িত্ব নেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকিতেও হয়ে উঠে না রূপসার চিকিৎসা। তার হার্টের বাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কলকাতায় গিয়ে অপারেশন করানো ছাড়া আর কোনো গতন্ত্যর থাকে না। সেখানে গিয়েও বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী পড়েন মহা সংকটে। মুসলিম ধর্মের হয়েও শুধুমাত্র মেয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতার সুরম্য হাসপাতালে তাদেরকে হিন্দু নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়! এখানেও অস্তিত্বহীনতার আরোপিত সংকট দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন গৌতম ঘোষ।

ধর্ম নাহয় পরিবর্তন করে কলকাতার হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করলেন বাদল মাস্টার, কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি? তারও ব্যবস্থা করেন টাকির ওই দাদু, যার ভরসায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছেন বাদল মাস্টার। ভারতীয়দের এমনসব মহানুভবতা পুরো সিনেমায় হর হামেশায় দেখা মেলে। শেষ পর্যন্ত টাকার ব্যবস্থা হলেও মারা যায় রুপসা। মেয়ের মৃত্যুর পর ব্যাপক ক্ষোভে অবৈধভাবে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়ে আসার কথা বলে দেয় বাদল মাস্টার। ফলত তাদেরকে অবৈধ অভিবাসি আখ্যা দিয়ে ভারতীয় জেলে পুরে মেয়ে রুপসার মৃত লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর রূপক হিসেবে গৌতম ঘোষ দেখান যে, বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু শঙ্খচিল ভারতের সীমানায় উড়ে যাচ্ছে…

Shongkhachil

মূলত ছবির গল্প এতুটুকু। কিন্তু এই গল্প দিয়ে গৌতম ঘোষ কি বুঝাতে চাইলেন আসলে? সীমানা তুলে দেয়ার গল্প বললেন? মানবিকতার গল্প বললেন? নাকি এই ছবির বাদল মাস্টারের মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চাইলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্য হাহাকারটা শুধুই বাংলাদেশের মানুষের! ভারতের মানুষ আনন্দে আছে, ওইখানে মেলা হয়, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, সেখানের মানুষগুলো মহানুভবতায় ঠাসা, এইসব? পুরো সিনেমাতেইতো এমন দাদাগিরিটা টিকিয়ে রাখলেন গৌতম ঘোষ? এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে অসংখ্য বাংলাদেশির মৃত্যুর বিষয়টিকেও পা মাড়িয়ে গেলেন তিনি।

এই যেমন, সিনেমার প্রথমেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে যে বাংলাদেশির মৃত্যু হয় তার খুনের দায় বিএসএফ নিজের ঘাড়ে না নিয়ে বরং ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দিয়ে সাফাই গাইতে শুনি। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যখন খুনের দায় কার? কিংবা সীমান্ত হত্যার দায়তো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদেরই বলে জিজ্ঞেস করেন, তখন সীমান্ত প্রধানকে আমরা বলতে শুনি ‘এই খুনের দায় কোনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর না, বরং ব্লাডি হিস্টোরি’র!’

আহা, কতো চমৎকার উত্তর এই উচ্চপদস্ত কর্মকরতার! একেরপর এক ফেলানীর মত মানুষকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখবে ভারতীয় জোয়ানরা, আর তাদের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ক্ষোভ দেখিয়ে ইতিহাসকে গালাগাল করে চুপ মেরে যাবেন! কি হাস্যকর, আর মর্মান্তিক যুক্তি! বাস্তবেও কি তাহলে প্রত্যেকটা বাঙালির সীমান্ত দিতে গিয়ে খুন হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা এমনই ইতিহাসের উপর দায় চাপিয়ে দিয়েছেন, বা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ। এই দেশের মানুষের চেয়ে হয়তো ভারতের মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ সুবিধা বেশি পায়। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কেউ কেউ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় জীবনকে মুঠোবন্দি করে রাতের অন্ধকারে ভারত পাড়ি দিতে চায়। কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলানোর ঘটনায় কোনো রকমের তোয়াক্কা না করে, জবাবদিহিতার ধার না ধেরে বরং উল্টো সেইসব সীমান্তের খুনকে বৈধতা দেয়ার জন্য গৌতম ঘোষের মত নির্মাতারা সিনেমাকে ব্যবহার করতে পারেন না। এটা অন্যায়। এসব স্পর্শ কাতর বিষয় নিয়ে এমন সরল ছেলেখেলা বড়ই নির্মম। অন্তত আমাদের জন্য।

বাংলাদেশের দর্শকদের খুশি করার জন্য কলকাতার ভালো মন্দ দুই শ্রেণির মানুষকে দেখানোর মত হাস্যকর ব্যালেন্সও করেছেন গৌতম ঘোষ। এই যেমন কলাকাতায় মেয়ে রূপসার চিকিৎসা বাবদ ব্যয়ের জন্য বাদল মাস্টার তার স্ত্রীর গয়না বিক্রি করার টাকা যখন এক ধান্দাবাজ ভাগিয়ে নিতে চাইল সেই মুহূর্তটি, এবং কিছু মানুষ পরম মমতায় কলকাতার রাস্তা থেকে তাদের উদ্ধার করলো। এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে কলকাতার রাতের রাস্তায়ও হোন্ডাওয়ালা তরুণদের দৌরাত্ম দেখানোর শটটি একেবারেই বেমানান ছিল।

কিছু দৃশ্যমান অসঙ্গতি ছিল, যা চোখে বেশ দৃষ্টিকটু। এই যেমন পুরো সিনেমায় দর্শক জেনে এসেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় শুধু কাঁটাতার দিয়ে বিভাজন। রূপসাকে (সাঁঝবাতি) মাঝে মধ্যে দেখাও গেছে কাঁটাতারের ফাঁকা দিয়ে ভারতীয় সেই জোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মূল সংকটটা যখন সিনেমায় শুরু হলো, মানে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রূপসার চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছিলেন বাদল মাস্টার ও তার স্ত্রী, তখন দেখা যায় দুই দেশের সীমানা মানে মাঝখান দিয়ে একটা নদী!

পুরো ছবিতে অভিনয়ে সবাই নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন বলে মনে হয়। যদিও রূপসা চরিত্রে সাঁঝবাতির অভিনয়ই বেশি প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রত্যেকের অভিনয় ইন্টেনশনাল একটা সিনেমার প্রেক্ষাপটের কাছে ম্লান হয়ে গেল! এক ধরনের আরোপিত ট্র‌াজেডি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সিনেমার সমাপ্তির চেষ্টাও তাই বৃথা গেল।

দুটো বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সীমানা, প্রাচীর, কাঁটাতার তুলে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে ফ্যান্টাসাইজ করে শঙ্খচিলে মানবিক গল্প পরিবেশন করার যে কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন তার সিনেমায় তা ইতিমধ্যে অন্তত বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে যথেষ্ঠ হাস্যখোরাকের জন্ম দিয়েছে। তাই খুব সরলভাবেই বলা যায়, সীমানা নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের যে ক্ষত আর গৌতম ঘোষের যে ইন্টেনশন তা এক নয়। দুই দেশের ভাঙন নিয়ে ঋত্বিকের হৃদয়ের ক্ষত শুধুমাত্র গৌতমের মত আলগা আবেগ দিয়ে মোড়ানো নয়। গৌতম ঘোষ ভালো নির্মাতা। কিন্তু সেই ভালো নির্মাতার প্রশংসাটা তিনি কালবেলা, পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা মনের মানুষের জন্য পাইতে পারেন, শঙ্খচিলের জন্য নয়।

আ লিটিল এলিজি ফর ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’/নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

প্রথমে আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কী নই আর তাহলে আমি কী। আমি ফেমিনিস্ট নই, আবার ইনটেনশনালি সেক্সিস্টও নই— ইনফ্যাক্ট আই অ্যাম দ্য ম্যাঙ্গো পিপল। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ ভালো সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তথাপি মনে হয় সিনেমা বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই কম, তাই বিশেষ তাত্ত্বিক কোনো আলোচনায় আমি যাবো না। জানি, বোদ্ধা ও দর্শকবর্গ এই সিনেমা নিয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন। এর মধ্যে বলেছেনও। যদিও ভালো বলার একশো তেরোটা কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি তেমন ভালো কোনো কথা বলবো না বলে ঠিক করেছি। তাই আমি নিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছি।
under_construction
সিনেমার নাম ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’। শুরুতেই খানিকটা কাহিনি সংক্ষেপে বলে নিই। রয়া একজন থিয়েটারকর্মী। বারোবছর ধরে মঞ্চে রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন তিনি। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় দলনেতা রাসেলভাই চরিত্রটিতে আরেকজনকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তরুণীরাই কেন শুধু নন্দিনী হতে পারবে এ প্রশ্ন ঘুরে মরে রয়ার মনে। সেই সময় ইন্ডিয়া থেকে ইমতিয়াজ নামের একজন নাট্যদলের অধিকারী আসেন। এসে নতুনভাবে ‘রক্তকরবী’কে মঞ্চে তোলার পরিকল্পনা করেন। রয়ার সঙ্গে তখন তার এক ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। একই সময় রয়ার কাজের মেয়ে ময়না লিফটম্যান সবুজমিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে কনসিভ করে। ফলত ময়না রয়ার ঘর ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে ওঠে। এবং সে গার্মেন্টস এ কাজ নেয়। এর মধ্যে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আর রয়ার তখন ঢাকা শহরকে রক্তকরবীর যক্ষপুরীই মনে হয়। তখন রক্তকরবীকে এইসব পেক্ষাপটে বিনির্মাণের চিন্তা তার মাথায় আসে। মূল কাহিনি মূলত তখনই থেকে শুরু হতে থাকে।
cover 02
এই সিনেমার প্রধান চরিত্র রয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাহানা গোস্বামী। তাকে ইতঃপূর্বে আমার ভালো লেগেছে সালমান রুশদীর উপন্যাস নিয়ে দীপা মেহতার বানানো সিনেমা মিডনাইট্স চিলড্রেনে মুমতাজ ও আমিনা চরিত্রে। ময়না চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিকিতা নন্দিনী, রয়ার মায়ের চরিত্রে মিতা চৌধুরী, আর ইমতিয়াজ চরিত্রে রাহুল বোস। রয়ার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করছেন শাহাদাত হোসেন। রাসেলভাই চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম। এছাড়া সোহেল মণ্ডল, স্পর্শীয়া নওশাবা আহমেদ সাবা প্রমুখ। সংগীত পরিচালক অর্ণব। নেপথ্য কণ্ঠ শাহানা বাজপেয়ী। ক্যামেরায় ছিলেন মার্টিন রডওয়ান। এডিটিং সুজন মাহমুদ। খনা টকিজ প্রযোজিত ও নিবেদিত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা রুবাইয়াত হোসেন। এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন দেখতে বসে প্রথেমেই সিনেমাটির প্রধান চরিত্র রিহার্সেলরত রয়ার নাভীর গভীরতায় আর মখমল পেটের ভাঁজে আমার চোখ আটকে গেলো। সে আয়নার সামনে নিজে নিজে রক্তকরবী নাটকের রিহার্সেল করছিলো। ধাক্কাটা এইভাবে খেলাম। ধাক্কা খাওয়ার কারণ ফেমিনিস্ট সিনেমা ভেবে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম। আর তাছাড়া নারীত্ব বিষয়টা পুরুষত্বের মতো শারীরিক কোনো বিষয় নয়। মানে নারীত্ব ব্যাপারটা শরীর নয়, এটা অনেকাংশে ব্যক্তিত্বের রূপায়ন। এটা পিতৃতান্ত্রিক/সামাজিক কাঠামোর কারণে নারীদের মাথায় ধীরে ধীরে তৈরি হয়। যেমন কোমল আর অবলার ধারণা তৈরি হয়। আর আমরা দেখেছি রয়ার অভিব্যক্তিতে কিন্তু শরীর দেখানোর বিষয়টা ছিলো না। থাকলে বিষয়টা অবান্তর আর সংলগ্নতাহীন মনে হতো না। ক্যামেরার ফোকাসিং এরও একটা বিষয় আছে। তারমানে এইখানে পরিচালকই রয়ার শরীর দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ইতঃপূর্বে ঋতুপর্ণ ঘোষের আবহমান সিনেমায় অনন্যা চ্যাটার্জিরও রিহার্সেলের দৃশ্যও আমরা দেখেছি। ওইদৃশ্য দেখে আমাদের মধ্যে এই রকম ধাক্কার সৃষ্টি হয় নাই। নন্দিনী তো একটা শক্তির নাম। সে তো শরীর নয়। আমি ছোটোবেলা থেকে রক্তকরবী অজস্রবার পড়েছি, অনেক মঞ্চে দেখেছি একবারও নন্দিনীকে শরীর মনে হয়নি, রুবাইয়াতের সিনেমা দেখে প্রথম মনে হলো।
কদিন আগে সিনেমাটির বিশেষ প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপনে দেখি কেবল নারীরা ফ্রি দেখতে পাবে। মনক্ষুণ্ণ হলেও মনে হলো সিনেমাটা মনে হয় নতুন কিছু হবে, ফেমিনিস্ট কোনো কিছু। কারণ রুবাইয়াত হোসেনের পূর্ববর্তী ছবি মেহেরজানের কাহিনিতে পলিটিকাল ইনটেনশন থাকলেও মেকিং ভালো ছিলো। তাছাড়া এইবার এবাদুর রহমান নাই জেনে ভাবলাম সিনেমা ভালোই হবে। কারণ মেহেরজানের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের একজন ছিলেন এই এবাদুর। আমাদের মনে আছে, মেহেরজানে পাকিবাহিনি থেকে পলাতক সৈনিকের প্রতি বাঙালি নারীর গদগদ প্রেম দেখিয়েছিলেন রুবাইয়াত। এবং তা আরোপিতই মনে হয়েছিলো তখন। তারপরও ভাবলাম, আন্ডার কনস্ট্রাকশনটা মুক্তি পেলে দেখবো নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রিমিয়ারেই দেখে এসে লিখতে বসলাম। সিনেমা ভালো হয়েছে, নিখুঁত মেকিং। আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন, ডায়ালগ থ্রোয়িং, ফ্রেইমিং, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়, সর্বোপরি এডিটিং ও মেকিং খুবই ভালো। বিশেষভাবে বলতে গেলে খুবই গভীর ভাবনা-চিন্তা আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন ইত্যাদিতে কাজ করেছে।
cover 02
কিন্তু ধাক্কাটা আমার জায়গা মতোই লাগলো। এরপর পুরো সিনেমাজুড়ে রয়ার শরীর দেখতে দেখতে, শরীরের উৎফুল্ল বাঁক দেখতে দেখতে সেই ধাক্কা কম্পনে পরিণত হলো। আমার মনে হলো প্রকৃত অর্থে, একটা সিনেমায় পরিচালক যা দেখাতে চান প্রধানত আমরা ম্যাঙ্গো পিপল তাই-ই দেখি। আর যা দেখাতে চান না সেই পাঠক্রম অন্যত্র বা উচ্চমার্গীয় দর্শকের জন্য।
রয়ার মা বলেন যে, তিনি স্বামীর টাকায় ফুটানি মারেন না। এইটা একটা সত্য কথা। এবং মেয়ের প্রতি মায়ের এই ঘা দেয়াটা আমার ভালো লাগে। যা তাকে জাগাতে সাহায্য করে। রয়াতো প্রকৃতঅর্থে স্বামীর টাকাতেই ফুটানি মারে, ময়নাকে দামি গয়নাগাটি উপহার দেয়। উন্মূল ময়নাকে গার্মেন্টসে কাজ করতে দেখে তারমধ্যে নারীবাদী চেতনা জেগে উঠে কিন্তু নিজেকে উন্মূল করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রয়া বড়লোকের বউ হয়ে সুবিধা নিতে পারে, কিন্তু বারো বছর মঞ্চে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয়ের পর তেত্রিশবছর বয়সেও ক্যারিয়ারের বিপরীতে সন্তানের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। তার স্বামীর সন্তান কামনাটাকে আমার কাছে অতি চাওয়া মনে হয় না কিংবা অনধিকারও মনে হয় না।
সন্তান তার কাছে তার ক্যারিয়ারের অন্তরায় মনে হয় কিন্তু পেটের ওপর থেকে ময়নার গর্ভস্থ শিশুর পায়ে হাত বুলিয়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও তার মধ্যে সন্তানের জন্য আকুতি তৈরি হতে দেখি।
যথারীতি সেই একই ট্যাবু, একই টাইপের মধ্যেই আটকে থাকার বিষয় প্রদর্শন করেন পরিচালক। যেমন, পাখির খাঁচার পরিবর্তে আমাদের দেখান জারের মাছ। পুরুষ ইমতিয়াজকেই দেখা যায় উদ্ধারকর্তা হিশেবে। যেমন, আবহমান কাল ধরে পুরুষই পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
গর্ভবতী কাজের মেয়ের পা কোলে নিয়ে নূপুর পরিয়ে দেয়ার বিষয়টা ঔচিত্যবোধের বাসনার রূপই হয়তো রুবাইয়াত হোসেন আমাদের দেখিয়েছেন। কিছু কিছু দৃশ্য দেখে মনে হয় এই সিনেমা আসলে নারীদের কী করা উচিত তার বিবরণ।
একা লাগে কিনা এহেন পারস্পরিক প্রশ্নে ইমতিয়াজ যখন রয়ার হাতের আঙুল স্পর্শ করে তখন পর্যন্ত ঠিক লাগে, কিন্তু ইমতিয়াজের আঙুল যখন রয়ার ওষ্ঠাধরে আরোহণ করে তখন মাথার মধ্যে দার্শনিক ভাবনা আসে, আমরা ভাবি নৈসঙ্গের আদি কারণ কাম। একই প্রশ্নে একই দৃশ্য আমরা পৃথিবীর আরো শখানেক সিনেমায় দেখেছি। অনেকে বলবেন রয়া অভ্যস্তার কামে ক্লান্ত। কিন্তু অভ্যস্ততার কামে ক্লান্তির জন্য পারস্পরিক দায়ের একটা ব্যাপার থাকে। হোয়াটএভার, কাহিনি সেটা নয়, কাহিনি হলো ইমতিয়াজ যখন বলে আমার একা লাগে কিন্তু ‘আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক’ এই জাতীয় কথা—তারপরে আঙুল থেকে ওষ্ঠাধরে আঙুল গেলে যে পরিণতির দিকে যায় তা এর সিকোয়েন্স হতে পারে না আর কি। এটা তখন পরিচালকের আরোপ মনে হয়। কারণ ইতঃপূর্বে প্রায় কাছাকাছি দৃশ্যে অপর্ণা সেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার সিনেমায় রাহুল বোসকে কেমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাও আমাদের মনে থাকার কথা। সুতরাং আমার আরো একবার মনে হলো পরিচালক যা দেখাতে চান আসলে আমরা তাহা-ই দেখি। মূলত ফোকাসিত শরীর আর আঙুলের পরিণতি আন্ডার কনস্ট্রাকশনের লাইনের বাইরে চলে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। রয়ার লক্ষ্যের এবং পথচলার মাঝখানে এই ব্যাপারটাকে (ইমতিয়াজের এই রূপ এবং রয়ার অনুমোদন) আমার কাছে একটা ধ্বংসযজ্ঞ মনে হয়। মনে হয় এই ব্যাপারটা সিনেমাটার উদ্দেশ্যটাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
কর্মক্লান্ত স্বামীর সঙ্গে নিষ্পৃহ শৃঙ্গারও ইতঃপূর্বে আমাদের দেখা। পাশের বালিশে শায়িত সাপ, গৃহস্থ স্বামীর এই সাপরূপ, এইরূপ ভয় দর্শনও আমাদের পূর্বপরিচিত, যেমন পরিচিত বাথটাবের পানিতে স্নানের সময় সাঁতরে বেড়াচ্ছে শামুক, কচ্ছপের বাচ্চা এইসব। জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু লোকটির সারাদিন টিভি সেটের সামনে বসে থাকা, নিউজচ্যানেল দেখাও আমাদের অনেক সিনেমায় দেখা হয়েছে। সিনেমার স্বপ্ন দৃশ্যগুলির মতো দৃশ্যও আবহমান বিশ্বের সুররিয়ালিস্ট সিনেমাগুলিতে অহরহ দেখা যায়।
তবে রক্তকরবী নাটকের ইপ্রোভাইজেশনের চেষ্টার বিষয়টা আমার কাছে তাও খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে। আরো খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে গ্রিনরুমের আয়নায় নন্দিনী রয়ার খুলে রাখা টিপ আয়নার সামনে দাঁড়ানো নতুন নন্দিনীর কপালে প্রতিস্থাপনে যে মনতাজ তৈরি হয় সেই বিষয়টা। তবে এই মেয়েটিকে দেখে আমাদের কলকাতার শৈবাল মিত্রের শজারুর কাঁটা সিনেমার কঙ্কনা সেন এর স্থলাভিষিক্ত নতুন নন্দিনীর সেইসব অনাত্মবিশ্বাসের কথাই মনে পড়ে যায়।
একটা হুজুরদের মিছিলের দৃশ্যে, ‘নাস্তিকদের হত্যা কর’ স্লোগান ঠিকই ছিলো। সিনেমাটা যে সময়ের পেক্ষাপটে বানানো ওইসময় রাজপথে এই ধরনের মিছিল ছিলো, এখনো আছে। মিছিল দেখে সিএনজি অটোরিক্শার ভিতর ভীত রয়ার মাথায় কাপড় দেয়াটাকে বা হাত ঢেকে ফেলাটাকেও আমার কাছে স্বাভাবিক এবং বাস্তব মনে হয়েছে। কারণ এহেন মিছিল থেকে হামলার রেকর্ডও আছে।
সিনেমার নামকরণও যথারীতি সার্থক। রয়া আন্ডার কনস্ট্রাকশনেই ছিলো শেষ পর্যন্ত। শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় সে একদিন নিজের পায়েই দাঁড়াবে।
শেষপর্যন্ত সিনেমাটা কথিত প্রগতিশীল এলিটদের বিনোদনের পপকর্ন আর পেপসি জুগিয়েছে বলা যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটা অনেকটা চুরি করে স্নানরত আদিবাসী নারীদের স্তনদলের অথবা স্তনদানরত ভিখিরিনীর ফটো উঠিয়ে আর্ন্তজাতিক পুরস্কার জিতে নেয়ার মতোই।
মোটামুটি শেষ কথা হলো, রুবাইয়াত হোসেন ডিরেক্টর হিশেবে খুবই স্মার্ট। এই বাঙলা সিনেমার আকালে তার আরো সিনেমা বানানো উচিত। আমরা দেখতে চাই। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি তাই এতো সমালোচনা করে ফেললাম, এতো খুঁত বের করে ফেললাম। আশা রাখছি, আগামীতেও করবো ইনশাল্লা।

আহা!, আক্ষেপ ও বিস্ময়মাখা এক দীর্ঘশ্বাস/ মোহাম্মদ ফয়সাল

AHA ! Poster Lowবলাই বাহুল্য যে একটি চলচ্চিত্র প্রথমত ও প্রধানত এর নির্মাতাকে প্রতিনিধিত্ব করে; নির্মাতার দর্শণ, সৃজনশীলতা, বিশ্বাস, মনস্তত্ত্ব, রুচিবোধ, অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয় চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি অনুষঙ্গে। এই সূত্র অনুসরণ করে শুধু ‘আহা!’ দেখে কোনও অনুসন্ধিৎসু দর্শক যদি এর পরিচালক সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি বেশ কিছু দিক খুঁজে পেতে পারেন। সেগুলো নিয়েই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

১.

স্থাপত্যশিল্পের প্রতি পরিচালকের নিদারুণ অনুরক্তি খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্রই হচ্ছে একটি ক্ষীয়মান পুরানো দালান। যা ভেঙ্গে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের পায়তাড়া চলছে। এছাড়া পরিচালক প্রাসঙ্গিকভাবেই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অংশে ঢাকার বিশেষ কিছু স্থাপত্যকীর্তি প্রদর্শন করেছেন। যেমনঃ রুবা (সাথী ইয়াসমীন) যখন বাংলাদেশে এসে বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ক্যাব করে নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তখন তার Point of View (POV) থেকে নভোথিয়েটার, জাতীয় সংসদ ভবন দেখানো হয়। আবার রুবা যখন কিসলুর (হুমায়ুন ফরিদী) সঙ্গে দেখা করে তখন তাদেরকে লালবাগের কেল্লায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পরিচালক বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশিল্প উপস্থাপন করেছেন এই চলচ্চিত্রে।

২.

পরিচালক ভীষণ রকম গোছানো, ফোকাসড, মিনিমালিস্ট। বিশাল ক্যানভাসে বিক্ষিপ্ত অজস্র ঘটনার সম্মিলন না ঘটিয়ে খুব সীমিত কলেবরে, অল্প সংখ্যক চরিত্রের মাধ্যমে ‘আহা!’র গল্প বলেছেন। এটা করতে গিয়ে আবার কোনরকম একঘেয়েমি তৈরী হয় নি। বরং ১২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই দর্শকের মনোযোগ ও আগ্রহ অটুটভাবে ধরে রাখতে সক্ষম। পরিচালক আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা একটা গল্প বা বিষয়বস্তু নির্বাচন করে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবার জন্য প্রতিটি বিভাগের ব্যপ্তি সীমিত রাখবার চেষ্টা করেছেন। উদাহারণস্বরুপ উল্লেখ করা যায় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত লোকেশনের প্রসঙ্গ। এই চলচ্চিত্রটির সিংহভাগ দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে শুধুমাত্র মল্লিক সাহেবের (তারিক আনাম) বাড়িতে; এই বাড়ির বারান্দা, বিভিন্ন ঘর আর উঠানেই চলচ্চিত্রটির প্রায় ৮০ শতাংশ দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। মূলতঃ স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুপরিকল্পিতভাবে দৃশ্যধারণ করবার জন্যই এ চলচ্চিত্রে অল্প সংখ্যক লোকেশন ব্যবহার করা হয়েছে।

আহা! সিনেমার কিসলু চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি

আহা! সিনেমার কিসলু চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি

৩.

সংগীতের প্রতি পরিচালকের অনুরক্তিও এই চলচ্চিত্রে লক্ষ্যণীয়। ‘আহা’র সংগীতায়োজন করেছেন দ্যেবজ্যেতি মিশ্র, যিনি এই চলচ্চিত্রের জন্য ৬টি মৌলিক গান সুর করেছেন এবং প্রতিটি গানের কথা লিখেছেন পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর নিজেই। গতানুগতিক অন্যান্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মত গানগুলোতে অভিনয়শিল্পীদের ঠোট মেলাতে (Lip Sync) বা নাচতে দেখা যায় না, বরং গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গানগুলোকে বিভিন্ন অংশে নেপথ্য সংগীত হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রগুলোর বিষাদ ও বিষন্নতা এই গানগুলোতেও সার্থকভাবে অনুরণিত হয়েছে যা এই চলচ্চিত্রের মূলভাবকে আরো পরিণত ও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে।

‘আহা!’ এক অর্থে কিছু নিঃসঙ্গ মানুষের একাকীত্বের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টার গল্প। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নির্বান্ধব, যারা নানাভাবে নিজেদের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর রুবা বাংলাদেশে এসে একাকী জীবন কাটাতে শুরু করে, তার কোন পুরানো বন্ধুবান্ধবকেও এখানে দেখা যায় না। এক পর্যায়ে পাশের বাড়ীর কিসলু নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে তার সখ্যতা তৈরী হয়, যিনি নিজেও একটি ফ্ল্যাটে একাকী জীবনযাপন করেন। রুবার বাবা মল্লিক সাহেব বিপত্নীক হয়েছেন বহু আগে ( কথাপ্রসঙ্গে জানা যায় রুবাকে মেট্রিক পরীক্ষার পর তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয় কারণ মা-মরা মেয়েকে দেখাশোনা করবার কেউ ছিল না), যাকে মধ্যরাতে স্ত্রীর পুরানো ঘরে মন খারাপ করে একলা বসে থাকতে দেখা যায়। রুবার মিনা খালারও (প্রজ্ঞা লাবণী) স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক আগে, যিনি রুবাকে নিয়ে এক বিকেলে ছাদে হেটে বেড়াবার সময় তার পোষা কবুতরগুলো দেখিয়ে বলেন “ওরাই তো আমার সংসার। আমার ছেলেমেয়ে, ওরাই তো সব!”

একটি দৃশ্যে কিসলুর বন্ধু খাদেমকে (খালেদ খান) বলতে শোনা যায় “আমি শেয়ার বাজার করি বলে কি কবিতা লিখতে পারব না? আরে যার চরিত্রে যত বেশী contrast, তার চরিত্রই তো তত বেশী interesting!” ‘আহা!’র প্রতিটি চরিত্রেই ভীষণ রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। খাদেম তার বন্ধুকে ‘ভেঁদামাছ’ বলে গালি দিলেও কিন্তু কিসলুকে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবসময় পরিপাটি করে আচড়ানো চুল এবং ভারী চশমা আর সাদামাটা পোশাক পড়া কিসলুকে দেখে খুব শান্ত, নিরীহ, গোবেচারা ধরণের মানুষ মনে হলেও, তাকে একসময় হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে দেখা যায়। সে যখন রুবাকে নিয়ে বুড়ীগঙ্গা সেতুতে ঘুরতে যায় তখন নদীর নোংড়া, দূষিত পানি দেখে চিৎকার করে বলে “ওই মানুষ! তোরা এত অসভ্য কেন? নিজেরা যেই নদীটাকে ব্যবহার করিস আবার সেই পানিই নষ্ট করে ফেলেছিস! তোদের লজ্জা করে না?” আবার কিসলুকে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রঙের আন্ডারগার্মেন্টস নিজের বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখা গেলেও তাকে সবসময় সাদা পাঞ্জাবী আর প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখা যায়। পোশাকের এরকম পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালক মূলতঃ কিসলু চরিত্রের বোকাটে বেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রগাড় প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বকেই ইঙ্গিত করেছেন।

আহা! সিনেমার একটি দৃশ্যে সাথি ইয়াসমিন ও হুমায়ূন ফরীদি

আহা! সিনেমার একটি দৃশ্যে সাথি ইয়াসমিন ও হুমায়ূন ফরীদি

এরকম ‘স্ববিরোধতা’ অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝেও দৃশ্যমান। যেমন মল্লিক সাহেবকে এখানে একজন নীতিবান, পরহেজগার মানুষ হিসাবে দেখানো হয়, আবার এই মল্লিক সাহেবই সোলেমান নামের এক স্বঘোষিত খুনীকে নিজের বাড়ীর দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ দেন, এমনকি চলচ্চিত্রের শেষ অংশে কিসলুকে হত্যা করবার নির্দেশও দেন যা তার মহনীয় ব্যক্তিত্বের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। আবার এই সোলেমানকে ক্রিকেট খেলার ভীষণ ভক্ত হিসাবে দেখা যায়, বাড়ীর কাজের ছেলে রতনের সাথে দেখা হলেই সে তাকে বাংলাদশের খেলার স্কোর জিজ্ঞাসা করে। রতন একসময় বিরক্ত হয়ে বলে ‘প্রতিদিনই কি বাংলাদেশের খেলা থাকে?’ কিন্তু এই সোলেমানই আবার পাড়ার ছেলেদের বাড়ীর সামনে ক্রিকেট খেলা মোটেও পছন্দ করে না এবং একবার ক্রিকেটের বল নিতে একটি ছেলে বাড়ীতে ঢুকলে তাকে বেধড়ক পেটায়। এরকমভাবে প্রতিটি চরিত্রের আচরণে নানারকম অসঙ্গতি দেখা যায় যা প্রকৃতঅর্থেই চরিত্রগুলোকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে।

শুধু চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বই নয়, বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে ব্যক্তিত্বের সংঘাতও এই চলচ্চিত্রে বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহারণস্বরুপ আসিফ (ফেরদৌস) ও কিসলু চরিত্র দু’টির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আসিফ একদিকে বেশ কেতাদুরস্ত, চঞ্চল, আধুনিক আর কিসলু কিছুটা রাশভারী, সাদাসিধা ও সেকেলে। তারা যখন রুবার ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে মিলিত হয় তখন তাদের নিজেদের পরিচয় দেবার পর্বটি বেশ কৌতুকাবহ। আসিফ নিজের সম্পর্কে বলে “আমি business করছি… মানে চেষ্টা করছি, Trying to do something.”, প্রত্যুত্তরে অপরজন বলে “আমি কিসলু, কিসলু হাসান, কিছু না করার চেষ্টা করছি।”

এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রের কথা বলার ধরণের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন রফিক সাহেব (শহিদুল আলম সাচ্চু) চাপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা এবং স্বভাবতই তার কথায় রাজশাহীর টান লক্ষ্য করা যায়। মল্লিক সাহেবের পাড়ার ছেলেরা পুরান ঢাকাবাসীর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে কথা বলে, আবার রুনা খালা কথা বলেন পুরোপুরি প্রমিত বাংলায়। আসিফ আর রুবাকে প্রচুর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের কথা বলার ধরণ একটু খটকা তৈরী করে কারণ তিনি পুরান ঢাকাতে জন্মগ্রহণ করেছেন ও প্রতিপালিত হয়েছেন কিন্তু কথা বলা বলেন শুদ্ধ বাংলায়।

মল্লিক সাহেবের ভঙ্গুরপ্রায় বাড়ীর জায়গায় নতুন দালান বানাবার প্রলোভন দেখাচ্ছে ‘Dream Properties’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান আর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসাবে দেখা যায় রফিক নামের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে যার উপস্থিতি যথাসম্ভব অপ্রীতিকরভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। গাড়ো কালো বর্ণের বেঢপ আকৃতির রফিক সাহেবকে ধূসর বর্ণের পোশাক, সোনালী ফ্রেমের চশমায় বেশ বিচিত্র লাগে, আর কথা বলার সময় অশালীন শব্দের ব্যবহার, অপরিশীলিত কার্যকলাপের মাধ্যমে (যেমনঃ কাপে ঢেলে শব্দ করে চুমুক দিয়ে চা খাওয়া, তোতলামি করা, বাতকর্ম করা) তাকে আরো বিরক্তিকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলতঃ মুনাফালোভী রিয়েল এস্টেট ডেভলপারদের অশুভ তৎপরতার প্রতি পরিচালকের বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে রফিক চরিত্রের মাধ্যমে। রফিক সাহেব সময়ে-অসময়ে মল্লিক সাহেবকে এসে বাড়ী ভাঙ্গার দলিলে স্বাক্ষর করবার জন্য তাগাদা দিয়ে বিরক্ত করেন, কিন্তু স্থাপত্যবিদ্যার কিছু শিক্ষার্থী যখন বাড়ীটির ছবি তুলবার জন্য ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চায়, তখন সোলেমান তাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেয় না। বর্তমান সমাজে ধূর্ত স্বার্থানেষী মানুষেরা যে খুব সহজেই নিজেদের সুযোগ তৈরী করে নেয় আর মননশীল লোকেরা নির্বিঘ্নে তাদের সুকুমার বৃত্তির পরিচর্যা করতে পারে না ,এই ঘটনা মাধ্যমে সেই বৈষম্যের দিকেই পরিচালক ইঙ্গিত করেছেন।

‘আহা!’ চলচ্চিত্রের অন্যতম রহস্যময়, জটিল ও মানসিকভাবে উপদ্রুত চরিত্র হচ্ছে সোলেমান এবং এই চরিত্রকে নিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালক কিছু মজার পন্থা অবলম্বন করেছেন। যেমনঃ সোলেমান উপস্থিতি রয়েছে এমন কিছু দৃশ্যের নেপথ্যে মাছির ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শোনা যায় যা এক ধরণের অস্বস্তি তৈরী করে। সোলেমানের স্বপ্নদৃশ্যে কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য (যেমনঃ হাতির ক্লোজ-আপ শট, বাংলা ছবির নায়িকার চেহারা) প্রদর্শন করে তার ভীতি, অবদমিত কামনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। পাড়ার ছেলদের সাথে আগ বাড়িয়ে বিবাদে জড়ানো, বুবার (রুবার ছেলে) খৎনার অনুষ্ঠানে আয়োজিত মুরগি লড়াইয়ের সময় তার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়া, বাড়ীর ছবি তুলতে আসা ছেলেদের সাথে অনর্থক দুর্ব্যবহার করা ইত্যাদি তার হিংস্রস্বত্তারই পরিচয় বহন করে।

চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত রুবার অবদমিত কামনাকেও পরিচালক একটি রূপক দৃশ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এই দৃশ্যটিতে কোন সংলাপ নেই, শুধু নেপথ্যে দ্রুত লয়ের একটি সংগীত শোনা যায়, যেখানে সমস্বরে কিছু পুরুষ বারংবার ‘আহা’ বলতে থাকে। এ দৃশ্যে ভারী বৃষ্টির মাঝে একদল ছেলেকে খালি গায়ে রুবাদের বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তারা মাঠে একটি ফুটবল নিয়ে খেলা শুরু করে, কিন্তু খেলায় কোনরকম শৃঙ্খলা দেখা যায় না। সবাইকে ফুটবলের দখল পেতে মরিয়া দেখা যায়। রুবা ছেলেগুলোকে খেলতে দেখে অবাক হয় না, বরং বাড়ি থেকে বের হয় আসে। বৃষ্টির মধ্যেই তাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায়, যেন সে ছেলেগুলোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে রুবা এবং খেলায় মগ্ন ছেলেগুলোকে কখনো এক ফ্রেমে দেখা যায় না। এ দৃশ্যের শেষ শটে দেখা যায়, রুবা চোখ বুঝে বৃষ্টির মাঝে ওপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ক্যামেরা তাকে ঘিরে ঘুরছে। হঠাৎ ঢাকের বাড়ির মধ্য দিয়ে নেপথ্য সংগীত শেষ হয়, আর রুবা চোখ মেলে ক্যামেরার দিকে তাকায়, যেন এ আওয়াজে সে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্য ও ক্লোজ-মিড-লং শটের সমন্বয়,অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের বিপরীতে রুবার হলুদ শাড়ি, হল্লারত ছেলেদের ফুটবল নিয়ে কাড়াকাড়ি, দ্রুত লয়ের সংগীত সব মিলিয়ে এ দৃশ্যটির মাধ্যমে নিপুনতার সঙ্গে পরিচালক রুবার শমিত বাসনাকে উপস্থাপন করেছেন।

যে গুটিকয়েক বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী তার মধ্যে অন্যতম ‘আহা!’। রুবা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অসহায়ত্ব পরিচালক সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রুবার বিয়ে হয়ে যায় বেশ অল্প বয়সেই, ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করেই এক প্রবাসী ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয় এবং সহজেই বোধগম্য যে বিয়েতে তার মতামত খুব একটা গুরুত্ব পায় নি। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলে বুবাকে নিয়ে রুবা দেশে ফিরে আসে, আশ্রয় নেয় বাবার ঘরে কিন্তু এখানেও সে নানাভাবে নিগৃহীত হতে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে বাবার মতামতের কাছে তাকে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করতে হয়। বুবার মুসলমানীর অনুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণভাবে করতে রাজী না থাকলেও বাবার গোয়ার্তুমির কাছে সে হার স্বীকার করে, বারংবার বাবাকে বাড়ী ভাঙ্গার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়, সোলেমানকে বিদায় করবার জন্য অনুরোধ করেও বাবাকে রাজী করাতে পারে না। রুবাকে অনেকবারই জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যা তার বন্দী দশাকেই রুপকঅর্থে ফুটিয়ে তোলে। মার্জিত, শিক্ষিত খালাতো ভাই আসিফও যখন অন্যায়ভাবে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করে তখন সে তার প্রতিবাদ করলেও রাতের আধারে তাকে অঝরে কাঁদতে দেখা যায়। একমাত্র কিসলুর সঙ্গেই তার একরকম সখ্যতা তৈরী হয়, কিন্তু এখানেও তার বাবা বাধা হয়ে দাড়ান। বাবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে রুবা তাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখার কথা বললে মল্লিক সাহেব কিসলুকে খুন করবার সিদ্ধান্ত নেন। তার মৃত্যুসংবাদ শুনে একবার কিসলুর বাড়ীতে যেতে চাইলেও বাবা তাকে টেনেহেচড়ে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলেন। এভাবে রুবাকে পদে পদে পরাজিত হতে দেখি। অপরদিকে মল্লিক সাহেব অনায়াসেই তার পুরানো দালান ভাঙ্গার অনুমতি দিলেও তার পুরাতন সংস্কারবোধে তিনি কোনরকম আচড় পড়তে দেন না।

সম্পাদনা সম্পর্কে আন্দ্রে তারকাভোস্কি বলেছিলেন যে হলিউডের কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে সেগুলোর সম্পাদনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যাবে এই চলচ্চিত্রগুলোর সম্পাদনা একই ব্যক্তি করেছেন। কিন্তু বার্গম্যান, ব্রেসো, কুরোশোয়া, এন্তোনিয়নিদের মত মেধাবী পরিচালকদের সম্পাদনার কৌশল বা স্টাইল একেকরকম, তাদের প্রত্যেকের সম্পাদনায় স্বকীয়তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে (পৃ-১২১, স্কাল্পটিং ইন টাইম)। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রেও পরিচালক নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আহা’র সম্পাদনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রচুর Cross-cutting (একই সময়ে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা সমান্তরালভাবে দেখানো) এর ব্যবহার যা সচরাচর কোন চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। সাধারণত উদ্বেগ (suspense) তৈরী করবার জন্য Cross-cutting এর ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এই চলচ্চিত্রে এর ব্যবহার করার পেছনে কারণ হিসাবে ধারণা করা যায় চলচ্চিত্রের ঘটনাপ্রবাহে কিছুটা গতি সঞ্চার করা। চলচ্চিত্রের শটগুলোর দৈর্ঘ্য প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছুটা দীর্ঘতর যা চলচ্চিত্রের আবহকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে, কিছু কিছু দৃশ্য একটিমাত্র শটেই ধারণ করা হয়েছে, যেমন পাড়ার ছেলেদের দ্বারা সোলেমানের প্রহৃত হবার দৃশ্য, পাশা ভাইয়ের সাথে পাড়ার ছেলেদের কথোপকথন ইত্যাদি যা পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে।

‘আহা!’ তে প্রচুর High Angle ও Low Angle Shot ব্যবহার করা হয়েছে, যার অনেকগুলোতেই পরিচালক চাইলেই ক্যামেরা Eye Level এ রাখতে পারতেন। নির্মাতা ইচ্ছা করেই এই ব্যতিক্রমী পন্থা অবলম্বন করেছেন যা দর্শককে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে কৌতুহলী ও মনোযোগী রাখতে সমর্থ হয়েছে। যেহেতু চলচ্চিত্রের বেশীর ভাগ অংশের চিত্রধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধ জায়গায় তাই যথোপযুক্তভাবেই এই চলচ্চিত্রে মিড শট ও ক্লোজ শটের প্রাধান্য খুব বেশী যা দর্শকের মনে একধরণের আবদ্ধ বা Claustrophobic অনুভূতি তৈরী করে। এই চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক Long Shot ব্যবহার করা হয়েছে রুবা ও কিসলুর ঘুরে বেড়ানো দৃশ্যে যেখানে তাদের লালাবাগের কেল্লা, বুড়ীগঙ্গার ব্রীজ প্রভৃতি জায়গায় গল্প করে বেড়াতে দেখা যায়। এই দৃশ্যগুলোতে Long Shot এর ব্যবহার করে শুধু সাময়িকভাবে রুবার মুক্ত হবার আনব্দকেই নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলে না এটা দর্শককেও একরকম Breathing Space দেয়।

‘আহা’ চলচ্চিত্রে অনেকজন প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীর সমাগম হয়েছে যাদের অসামান্য অভিনয় এই চলচ্চিত্রটিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। তারেক আনাম খান, হুমায়ুন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু প্রত্যেকেই নিপুনভাবে নিজেদের চরিত্র রুপায়ন করেছেন যা চলচ্চিত্রটির প্রতি তাদের মমতা ও দায়বদ্ধতারই (commitment) পরিচয় বহন করে। বেশীর ভাগ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ ৩/৪ টি চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু অন্যান্য শিল্পীদের দুর্বল অভিনয়ের কারণে অনেক সময় চলচ্চিত্রগুলো ন্যূনতম মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রটি এই দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। এখানে প্রতিটি চরিত্রকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট চরিত্রেগুলোতে শহীদুল আলম সাচ্চু,গাজী রাকায়েত,প্রজ্ঞা লাবনীর মত কুশীলবদের প্রাণবন্ত ও সাবলীল অভিনয় চলচ্চিত্রটিকে বাস্তবিক করে তুলেছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়বে কিসলুর বন্ধুর চরিত্র রুপদানকারী খালেদ খানের অনবদ্য অভিনয়। তার বাচনভঙ্গী, একটু পরপর বিচিত্রভাবে হাত ঝাঁকি দেয়া, চপল (Prankinsh) চাহনি ও কৌতুকময় সংলাপ বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে যা তার খুব সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিকেও তাৎপর্যময় করে তুলেছে।

এই চলচ্চিত্রের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছে সাথী ইয়াসমীন যে কি-না এই চলচ্চিত্রের অন্যান্য শিল্পীদের তুলনায় কিছুটা কম পরিচিত। ‘আহা!’র কলাকুশলীদের এক টেলিভিশন আলাপচারিতায় পরিচালক নির্ঝর কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন যে এ চরিত্রটির করবার জন্য তিনি অনেককেই প্রস্তাব দিয়েছেন যারা কেউই সাড়া না দেয়ায় তিনি কিছুটা হতাশও হয়ে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হুমায়ুন ফরিদী এই প্রসঙ্গে বলেন যে সাধারণত জনপ্রিয় নায়িকারা কোন বাচ্চার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চায় না কারণ তারা মনে করে যে এতে দর্শকদের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা কমে যায়। যেখানে সমসাময়িক অন্যান্য কলাকুশলীদের মাঝে এমন উদ্ভট ও অপেশাদারী মনোভাব কাজ করে, সেখানে পরম মমতায় রুবা চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলবার জন্য সাথী ইয়াসমীন আন্তরিক সাধুবাদের দাবিদার।

ইদানীং খুব হেলাফেলায় চলচ্চিত্র নির্মান করে পরিচালকদের তা নিয়ে অহেতুক বড়াই করতে দেখা যায়, কিন্তু একটি চলচ্চিত্রের সবধরণের দুর্বলতা উপেক্ষা বা ক্ষমা করা গেলেও যা ক্ষমার অযোগ্য তা হচ্ছে চলচ্চিত্রটির প্রতি পরিচালকের উদাসীনতা।কেউ যদি শুধুমাত্র এ ব্যাপারটি মাথায় রেখে ‘আহা!’কে মূল্যায়ন করতে চায় তাহলে হয়ত সে একতরফাভাবে এর ভূয়সী প্রশংসা করে গেলেও অপরাধ করবে না কারণ চলচ্চিত্রটির প্রতিটি বিভাগে নির্মাতার যত্ন,চিন্তা ও পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। এনামুল করিম নির্ঝর সরকারী অনুদানে এরপর আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মান করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা এখনো মুক্তি দিতে পারেন নি। ‘আহা!’ নির্মানের পর গত ৬ বছরে এই পরিচালকের আর কোন নতুন কাজ দেখবার সুযোগ হয় নি! এটা চিন্তা করলে, পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্রটি দেখে বনে যাওয়া ভক্তরা হয়ত নিজের অজান্তেই অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ উচ্চারণ করবেন- ‘আহা!’

শুনতে কি পাও: আমার সিনেমা দর্শন/ইলিয়াস কমল

শুনতে কি পাও

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালো’র কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি “শুনতে কি পাও” এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি ‘শুনতে কি পাও’ এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসব ‘সিনেমা দ্যু রিলে’ মূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ ছবি’রপুরষ্কার ‘গ্রা প্রী’ পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। ক’দিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে।
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে ‘আম’ পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।
বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের।