আ লিটিল এলিজি ফর ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’/নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

প্রথমে আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কী নই আর তাহলে আমি কী। আমি ফেমিনিস্ট নই, আবার ইনটেনশনালি সেক্সিস্টও নই— ইনফ্যাক্ট আই অ্যাম দ্য ম্যাঙ্গো পিপল। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ ভালো সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তথাপি মনে হয় সিনেমা বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই কম, তাই বিশেষ তাত্ত্বিক কোনো আলোচনায় আমি যাবো না। জানি, বোদ্ধা ও দর্শকবর্গ এই সিনেমা নিয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন। এর মধ্যে বলেছেনও। যদিও ভালো বলার একশো তেরোটা কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি তেমন ভালো কোনো কথা বলবো না বলে ঠিক করেছি। তাই আমি নিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছি।
under_construction
সিনেমার নাম ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’। শুরুতেই খানিকটা কাহিনি সংক্ষেপে বলে নিই। রয়া একজন থিয়েটারকর্মী। বারোবছর ধরে মঞ্চে রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন তিনি। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় দলনেতা রাসেলভাই চরিত্রটিতে আরেকজনকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তরুণীরাই কেন শুধু নন্দিনী হতে পারবে এ প্রশ্ন ঘুরে মরে রয়ার মনে। সেই সময় ইন্ডিয়া থেকে ইমতিয়াজ নামের একজন নাট্যদলের অধিকারী আসেন। এসে নতুনভাবে ‘রক্তকরবী’কে মঞ্চে তোলার পরিকল্পনা করেন। রয়ার সঙ্গে তখন তার এক ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। একই সময় রয়ার কাজের মেয়ে ময়না লিফটম্যান সবুজমিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে কনসিভ করে। ফলত ময়না রয়ার ঘর ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে ওঠে। এবং সে গার্মেন্টস এ কাজ নেয়। এর মধ্যে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আর রয়ার তখন ঢাকা শহরকে রক্তকরবীর যক্ষপুরীই মনে হয়। তখন রক্তকরবীকে এইসব পেক্ষাপটে বিনির্মাণের চিন্তা তার মাথায় আসে। মূল কাহিনি মূলত তখনই থেকে শুরু হতে থাকে।
cover 02
এই সিনেমার প্রধান চরিত্র রয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাহানা গোস্বামী। তাকে ইতঃপূর্বে আমার ভালো লেগেছে সালমান রুশদীর উপন্যাস নিয়ে দীপা মেহতার বানানো সিনেমা মিডনাইট্স চিলড্রেনে মুমতাজ ও আমিনা চরিত্রে। ময়না চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিকিতা নন্দিনী, রয়ার মায়ের চরিত্রে মিতা চৌধুরী, আর ইমতিয়াজ চরিত্রে রাহুল বোস। রয়ার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করছেন শাহাদাত হোসেন। রাসেলভাই চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম। এছাড়া সোহেল মণ্ডল, স্পর্শীয়া নওশাবা আহমেদ সাবা প্রমুখ। সংগীত পরিচালক অর্ণব। নেপথ্য কণ্ঠ শাহানা বাজপেয়ী। ক্যামেরায় ছিলেন মার্টিন রডওয়ান। এডিটিং সুজন মাহমুদ। খনা টকিজ প্রযোজিত ও নিবেদিত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা রুবাইয়াত হোসেন। এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন দেখতে বসে প্রথেমেই সিনেমাটির প্রধান চরিত্র রিহার্সেলরত রয়ার নাভীর গভীরতায় আর মখমল পেটের ভাঁজে আমার চোখ আটকে গেলো। সে আয়নার সামনে নিজে নিজে রক্তকরবী নাটকের রিহার্সেল করছিলো। ধাক্কাটা এইভাবে খেলাম। ধাক্কা খাওয়ার কারণ ফেমিনিস্ট সিনেমা ভেবে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম। আর তাছাড়া নারীত্ব বিষয়টা পুরুষত্বের মতো শারীরিক কোনো বিষয় নয়। মানে নারীত্ব ব্যাপারটা শরীর নয়, এটা অনেকাংশে ব্যক্তিত্বের রূপায়ন। এটা পিতৃতান্ত্রিক/সামাজিক কাঠামোর কারণে নারীদের মাথায় ধীরে ধীরে তৈরি হয়। যেমন কোমল আর অবলার ধারণা তৈরি হয়। আর আমরা দেখেছি রয়ার অভিব্যক্তিতে কিন্তু শরীর দেখানোর বিষয়টা ছিলো না। থাকলে বিষয়টা অবান্তর আর সংলগ্নতাহীন মনে হতো না। ক্যামেরার ফোকাসিং এরও একটা বিষয় আছে। তারমানে এইখানে পরিচালকই রয়ার শরীর দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ইতঃপূর্বে ঋতুপর্ণ ঘোষের আবহমান সিনেমায় অনন্যা চ্যাটার্জিরও রিহার্সেলের দৃশ্যও আমরা দেখেছি। ওইদৃশ্য দেখে আমাদের মধ্যে এই রকম ধাক্কার সৃষ্টি হয় নাই। নন্দিনী তো একটা শক্তির নাম। সে তো শরীর নয়। আমি ছোটোবেলা থেকে রক্তকরবী অজস্রবার পড়েছি, অনেক মঞ্চে দেখেছি একবারও নন্দিনীকে শরীর মনে হয়নি, রুবাইয়াতের সিনেমা দেখে প্রথম মনে হলো।
কদিন আগে সিনেমাটির বিশেষ প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপনে দেখি কেবল নারীরা ফ্রি দেখতে পাবে। মনক্ষুণ্ণ হলেও মনে হলো সিনেমাটা মনে হয় নতুন কিছু হবে, ফেমিনিস্ট কোনো কিছু। কারণ রুবাইয়াত হোসেনের পূর্ববর্তী ছবি মেহেরজানের কাহিনিতে পলিটিকাল ইনটেনশন থাকলেও মেকিং ভালো ছিলো। তাছাড়া এইবার এবাদুর রহমান নাই জেনে ভাবলাম সিনেমা ভালোই হবে। কারণ মেহেরজানের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের একজন ছিলেন এই এবাদুর। আমাদের মনে আছে, মেহেরজানে পাকিবাহিনি থেকে পলাতক সৈনিকের প্রতি বাঙালি নারীর গদগদ প্রেম দেখিয়েছিলেন রুবাইয়াত। এবং তা আরোপিতই মনে হয়েছিলো তখন। তারপরও ভাবলাম, আন্ডার কনস্ট্রাকশনটা মুক্তি পেলে দেখবো নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রিমিয়ারেই দেখে এসে লিখতে বসলাম। সিনেমা ভালো হয়েছে, নিখুঁত মেকিং। আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন, ডায়ালগ থ্রোয়িং, ফ্রেইমিং, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়, সর্বোপরি এডিটিং ও মেকিং খুবই ভালো। বিশেষভাবে বলতে গেলে খুবই গভীর ভাবনা-চিন্তা আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন ইত্যাদিতে কাজ করেছে।
cover 02
কিন্তু ধাক্কাটা আমার জায়গা মতোই লাগলো। এরপর পুরো সিনেমাজুড়ে রয়ার শরীর দেখতে দেখতে, শরীরের উৎফুল্ল বাঁক দেখতে দেখতে সেই ধাক্কা কম্পনে পরিণত হলো। আমার মনে হলো প্রকৃত অর্থে, একটা সিনেমায় পরিচালক যা দেখাতে চান প্রধানত আমরা ম্যাঙ্গো পিপল তাই-ই দেখি। আর যা দেখাতে চান না সেই পাঠক্রম অন্যত্র বা উচ্চমার্গীয় দর্শকের জন্য।
রয়ার মা বলেন যে, তিনি স্বামীর টাকায় ফুটানি মারেন না। এইটা একটা সত্য কথা। এবং মেয়ের প্রতি মায়ের এই ঘা দেয়াটা আমার ভালো লাগে। যা তাকে জাগাতে সাহায্য করে। রয়াতো প্রকৃতঅর্থে স্বামীর টাকাতেই ফুটানি মারে, ময়নাকে দামি গয়নাগাটি উপহার দেয়। উন্মূল ময়নাকে গার্মেন্টসে কাজ করতে দেখে তারমধ্যে নারীবাদী চেতনা জেগে উঠে কিন্তু নিজেকে উন্মূল করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রয়া বড়লোকের বউ হয়ে সুবিধা নিতে পারে, কিন্তু বারো বছর মঞ্চে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয়ের পর তেত্রিশবছর বয়সেও ক্যারিয়ারের বিপরীতে সন্তানের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। তার স্বামীর সন্তান কামনাটাকে আমার কাছে অতি চাওয়া মনে হয় না কিংবা অনধিকারও মনে হয় না।
সন্তান তার কাছে তার ক্যারিয়ারের অন্তরায় মনে হয় কিন্তু পেটের ওপর থেকে ময়নার গর্ভস্থ শিশুর পায়ে হাত বুলিয়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও তার মধ্যে সন্তানের জন্য আকুতি তৈরি হতে দেখি।
যথারীতি সেই একই ট্যাবু, একই টাইপের মধ্যেই আটকে থাকার বিষয় প্রদর্শন করেন পরিচালক। যেমন, পাখির খাঁচার পরিবর্তে আমাদের দেখান জারের মাছ। পুরুষ ইমতিয়াজকেই দেখা যায় উদ্ধারকর্তা হিশেবে। যেমন, আবহমান কাল ধরে পুরুষই পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
গর্ভবতী কাজের মেয়ের পা কোলে নিয়ে নূপুর পরিয়ে দেয়ার বিষয়টা ঔচিত্যবোধের বাসনার রূপই হয়তো রুবাইয়াত হোসেন আমাদের দেখিয়েছেন। কিছু কিছু দৃশ্য দেখে মনে হয় এই সিনেমা আসলে নারীদের কী করা উচিত তার বিবরণ।
একা লাগে কিনা এহেন পারস্পরিক প্রশ্নে ইমতিয়াজ যখন রয়ার হাতের আঙুল স্পর্শ করে তখন পর্যন্ত ঠিক লাগে, কিন্তু ইমতিয়াজের আঙুল যখন রয়ার ওষ্ঠাধরে আরোহণ করে তখন মাথার মধ্যে দার্শনিক ভাবনা আসে, আমরা ভাবি নৈসঙ্গের আদি কারণ কাম। একই প্রশ্নে একই দৃশ্য আমরা পৃথিবীর আরো শখানেক সিনেমায় দেখেছি। অনেকে বলবেন রয়া অভ্যস্তার কামে ক্লান্ত। কিন্তু অভ্যস্ততার কামে ক্লান্তির জন্য পারস্পরিক দায়ের একটা ব্যাপার থাকে। হোয়াটএভার, কাহিনি সেটা নয়, কাহিনি হলো ইমতিয়াজ যখন বলে আমার একা লাগে কিন্তু ‘আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক’ এই জাতীয় কথা—তারপরে আঙুল থেকে ওষ্ঠাধরে আঙুল গেলে যে পরিণতির দিকে যায় তা এর সিকোয়েন্স হতে পারে না আর কি। এটা তখন পরিচালকের আরোপ মনে হয়। কারণ ইতঃপূর্বে প্রায় কাছাকাছি দৃশ্যে অপর্ণা সেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার সিনেমায় রাহুল বোসকে কেমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাও আমাদের মনে থাকার কথা। সুতরাং আমার আরো একবার মনে হলো পরিচালক যা দেখাতে চান আসলে আমরা তাহা-ই দেখি। মূলত ফোকাসিত শরীর আর আঙুলের পরিণতি আন্ডার কনস্ট্রাকশনের লাইনের বাইরে চলে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। রয়ার লক্ষ্যের এবং পথচলার মাঝখানে এই ব্যাপারটাকে (ইমতিয়াজের এই রূপ এবং রয়ার অনুমোদন) আমার কাছে একটা ধ্বংসযজ্ঞ মনে হয়। মনে হয় এই ব্যাপারটা সিনেমাটার উদ্দেশ্যটাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
কর্মক্লান্ত স্বামীর সঙ্গে নিষ্পৃহ শৃঙ্গারও ইতঃপূর্বে আমাদের দেখা। পাশের বালিশে শায়িত সাপ, গৃহস্থ স্বামীর এই সাপরূপ, এইরূপ ভয় দর্শনও আমাদের পূর্বপরিচিত, যেমন পরিচিত বাথটাবের পানিতে স্নানের সময় সাঁতরে বেড়াচ্ছে শামুক, কচ্ছপের বাচ্চা এইসব। জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু লোকটির সারাদিন টিভি সেটের সামনে বসে থাকা, নিউজচ্যানেল দেখাও আমাদের অনেক সিনেমায় দেখা হয়েছে। সিনেমার স্বপ্ন দৃশ্যগুলির মতো দৃশ্যও আবহমান বিশ্বের সুররিয়ালিস্ট সিনেমাগুলিতে অহরহ দেখা যায়।
তবে রক্তকরবী নাটকের ইপ্রোভাইজেশনের চেষ্টার বিষয়টা আমার কাছে তাও খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে। আরো খানিকটা অভিনব মনে হয়েছে গ্রিনরুমের আয়নায় নন্দিনী রয়ার খুলে রাখা টিপ আয়নার সামনে দাঁড়ানো নতুন নন্দিনীর কপালে প্রতিস্থাপনে যে মনতাজ তৈরি হয় সেই বিষয়টা। তবে এই মেয়েটিকে দেখে আমাদের কলকাতার শৈবাল মিত্রের শজারুর কাঁটা সিনেমার কঙ্কনা সেন এর স্থলাভিষিক্ত নতুন নন্দিনীর সেইসব অনাত্মবিশ্বাসের কথাই মনে পড়ে যায়।
একটা হুজুরদের মিছিলের দৃশ্যে, ‘নাস্তিকদের হত্যা কর’ স্লোগান ঠিকই ছিলো। সিনেমাটা যে সময়ের পেক্ষাপটে বানানো ওইসময় রাজপথে এই ধরনের মিছিল ছিলো, এখনো আছে। মিছিল দেখে সিএনজি অটোরিক্শার ভিতর ভীত রয়ার মাথায় কাপড় দেয়াটাকে বা হাত ঢেকে ফেলাটাকেও আমার কাছে স্বাভাবিক এবং বাস্তব মনে হয়েছে। কারণ এহেন মিছিল থেকে হামলার রেকর্ডও আছে।
সিনেমার নামকরণও যথারীতি সার্থক। রয়া আন্ডার কনস্ট্রাকশনেই ছিলো শেষ পর্যন্ত। শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় সে একদিন নিজের পায়েই দাঁড়াবে।
শেষপর্যন্ত সিনেমাটা কথিত প্রগতিশীল এলিটদের বিনোদনের পপকর্ন আর পেপসি জুগিয়েছে বলা যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটা অনেকটা চুরি করে স্নানরত আদিবাসী নারীদের স্তনদলের অথবা স্তনদানরত ভিখিরিনীর ফটো উঠিয়ে আর্ন্তজাতিক পুরস্কার জিতে নেয়ার মতোই।
মোটামুটি শেষ কথা হলো, রুবাইয়াত হোসেন ডিরেক্টর হিশেবে খুবই স্মার্ট। এই বাঙলা সিনেমার আকালে তার আরো সিনেমা বানানো উচিত। আমরা দেখতে চাই। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি তাই এতো সমালোচনা করে ফেললাম, এতো খুঁত বের করে ফেললাম। আশা রাখছি, আগামীতেও করবো ইনশাল্লা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s