সীমানা পেরিয়ে অন্য সীমানায়/শাহাদাত হোসেন

শিল্পীকে অন্য আর দশটা মানুষের চাইতে বেশী তার সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। সমাজের ছোট-বড় সঙ্গতি-অসঙ্গতিকে শিল্পী যেভাবে ধারন করেন সেটা বোধকরি আর কেউ পারে না। তা শিল্পী কিভাবে তৈরী হন বা কোন পথে গেলে শিল্পী হওয়া যায়? প্রকৃত অর্থে তার কোনও শর্টকাট রাস্তা নেই। সুইডিশ কবি মারিয়া ওয়াইন বলছেন ‘That one sleeps in one’s childhood shoe’ মানুষের শৈশব তার পরবর্তী জীবনজুড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শৈশবের ছায়া তার কাজে, কর্মে, মননে জিজ্ঞাসার মধ্যে থাকে। তবু প্রত্যেকেরই কত আলাদা শৈশব, কৈশোর বেড়ে ওঠা।

আমার এই ছবির গল্পের সুত্রপাত আমার শৈশবের মধ্যেই। আসলে হিজড়া কি বা কারা হিজড়া এটা বুঝিনা তখনো। সেই প্রি-কর্পোরেট যুগে খুব সম্ভবত ১৯৮৯-৯০ সালের কথা। পাড়ার মাঠে আমরা সবাই ফুটবল খেলছিলাম। শীতের সময় দিনের বেলাটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। আসরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে চলে যেতাম খেলার জন্য। তা সেদিনও যথারীতি মাঠেই খেলছি। হঠাৎ খেলা চলার সময় বেশ শব্দে ঢোল আর তালির শব্দ কানে আসল। এরই মধ্যে আমার খেলার সঙ্গীদের কেউ একজন ‘ওই হিজলা আইছে’ বলেই ভো দৌড়। বাকিরাও অনেকটা বুঝে না বুঝে দিলো দৌড়। আমিও সেই দলে ছিলাম। তা দৌড়ে পাশের বস্তির মধ্যে একটা উঠানের মত খোলা জায়গায় দেখি একদল অদ্ভুত দর্শন মানুষ শাড়ি, ব্লাউজ পরে ঠোটে লিপস্টিক লাগিয়ে একটা বাচ্চাকে হাতের তালুতে দুলাচ্ছে আর গান গাইছে। সঙ্গের অন্যরা সেখানে কোরাসে গাইছে আর কান ফাটানো শব্দে হাত তালি দিচ্ছে। যেন সার্কাস দেখছি আর অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি। ওদেরকে মনে হচ্ছিল জাদুকর। আমার কিশোর চোখে সে ছবি এখনো আটকে আছে। ওরা নাচছে গাইছে, হাত তালি দিচ্ছে আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। আমার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছেনা, অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। কোনভাবেই আমার চোখের পলক পড়ছে না। হঠাৎ করে বাজপাখির ক্ষীপ্রতায় এক হিজড়া এসে আমাকে এসে জাপটে ধরল। সে আমাকে এতটা জোরে জাপটে ধরে যে তার প্যাডেড ব্রা’র স্ফীতাংশ চিমশে গিয়ে পাথরের মত বুকের কাঠিন্য আমি বুঝেছিলাম। সে বেশ অনেকক্ষণ আমাকে জাপটে থাকল। এতক্ষণ আমার প্রেমিকা ছাড়া আর আমাকে জাপটে থাকেনি কখনো। আমার দম আটকে আসছিল বোটকা ঘাম আর পেশীবহুল শরীরের চাপে। আমি চোখেমুখে কিছুই দেখছিলাম না। আমি জানিনা কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলাম। তবে ৫০ সেকেন্ড ছিলাম। আমার ধারনা যদিও তখন মনে হচ্ছিল ৫০ দিন আমি তার বুকের মধ্যে আটকে ছিলাম। যেহেতু পালাবার কোনও পথ নাই। সে হঠাৎ আমাকে তার বুকের পাশ থেকে অবমুক্ত করে আমার কাধে হাত রেখে বলল ‘কি রে কি দেখলি ঢাকা না দিল্লী?’ আমি ঘোরের মধ্যেই উত্তর দিলাম দিল্লী। এই একটি কথা আমার কানে এখনো বাজে। আর এই একটি প্রশ্নের উত্তর আমি আমার গোটা শৈশব কৈশোরে খুঁজেছি। কখনো কিছুটা মিলেছে, কখনো প্রশ্নটাই ধোয়াশা হয়ে উঠেছে নিজের কাছে। সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজছি এখনো। আমার নিজের মধ্যে জেগে থাকা এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার ছবিতে দেয়ার চেষ্টা করছি।

এই ছবি যদি কোনকিছু করতে পারে তবে সেটা হবে আমার উত্তরটা যদি মিলে যায় কোনভাবে? আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি, ঢাকায়, নারায়ণগঞ্জে, কলকাতায়, দিল্লীতে। ভিন্ন সীমান্তের অভিন্ন এই মানুষেরাই আমার ছবির প্রাণ। তাদের না বলা গল্প তারা আমাদেরকে বলেছে। আর তাদের না জানা গল্পগুলো আমরা শুনেছি। যা হয়ত প্রতিদিন বসে বসে অনেক আলাপের ভেতর থেকে জানা। আর একসঙ্গে থাকার যে কমিউনিটি লিভিং আমরা দেখেছি, হিপ্পি জেনারেশনের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তার একটা সেন্স আমি পেয়েছি এদের সঙ্গে মিশে। আমার ছবির এইসব মানুষেরাও জীবনের প্রয়োজনে অনেকে এক হয়ে থাকেন। ছোট্ট একটা ঘরে গুরু, নানগুরু, সহকর্মী, প্রেমিক আবার কখনো পালিত শিশুসহ ওরা একসঙ্গেই থাকে। আমরা এইসব মানুষের স্বপ্ন আর লড়াইয়ের গল্পটাই সিনেমার ভাষায় তুলে আনতে চাইছি। ঢাকার গোড়ানে ৯ ভাইবোনের সংসারে একজন কথার জন্ম হয়ে। আসলে কি সে এমন মনোজগত নিয়ে জন্মেছিল নাকি তার পরিপার্শ্বের গলি-ঘুপচি ঘুরে তার আদমের জীবন চাইতে ইচ্ছে করেনি। নাকি সে শুধু বৃহন্নলার জীবন নিয়ে মানুষের কাতারে দাঁড়াতে চেয়েছে? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজেছি বা নিরন্তর খুঁজেই বেড়াচ্ছি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s